প্রেরিতগণের কার্য-বিবরণ
৫৪ অধ্যায়—বিশ্বস্ত সাক্ষি
খ্রীষ্টের স্বর্গারোহনের পর যোহন প্রভুর পক্ষে বিশ্বস্ত পরিচর্যাকারী রূপে দৃঢ়তার সংগে অগ্রসর হয়েছিলেন। অন্য শিষ্যদের সঙ্গে তিনিও পঞ্চাশত্তমীর দিনে পবিত্র আত্মা তাঁর উপর নেমে আসার আনন্দ উপভোগ করেছিলেন এবং নব উদ্দীপনায় এবং নব শান্তিতে তিনি অব্যাহত ভাবে লোকদের কাছে জীবনের বাক্য প্রকাশ করে গেছেন, তিনি তাদের চিন্তাকে অজ্ঞাত বিষয়ের দিকে চালিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী প্রচারক, উত্তপ্ত হুদয়ের অধিকারী এবং গভীর আন্তরিকতায় পূর্ণ মানুষ। চমৎকার ভাষায় এবং সুরেলা কণ্ঠে নতিনি বাক্য প্রচার করেছিলেন এবং খ্রীষ্টের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে যারা তা শুনত তাদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করত। তাঁর কথার সারল্যতার মধ্য দিয়ে তিনি সত্যের মহিমান্বিত শক্তিতে প্রকাশ করেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষার বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে তিনি সকল শ্রেণীর লোকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। AABen 460.1
প্রেরিতের জীবন তাঁর শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। খ্রীষ্টের জন্য তাঁর যে ভালবাসা ছিল যা তাঁর অন্তরকে আলোকিত করে স্থির সঙ্কল্পে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, সহমনুষ্যদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে, বিশেষ করে খ্রীষ্টিয় মন্ডলীতে তাঁর ভ্রাতৃবর্গের জন্য অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করার কাজে চালিত করেছিল। AABen 460.2
খ্রীষ্ট শিষ্যদের প্রথম আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, তিনি যেমন তাঁদের ভালবাসেন তেমনি তাঁরাও যেন পরস্পরকে ভালবাসেন। তাহলে এই ভাবে তাঁরা জগতের কাছে সাক্ষ্য বহন করতে পারবেন, যার মধ্যে খ্রীষ্ট মহিমার প্রত্যাশা গঠন করেছেন। “এক নূতন আজ্ঝা আমি তোমাদিগকে দিতেছি,” তিনি বলেছেন, “তোমরা পরস্পর প্রেম কর, আমি যেমন তোমাদিগকে প্রেম করিয়াছি, তোমরাও তেমনি পরস্পর প্রেম কর।” যোহন ১৩:৩৪। যে সময় এই কথাগুলো বলা হয়েছিল তখন শিষ্যরা এই কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারেননি, কিন্তু খ্রীষ্টের দুঃখভোগের সাক্ষী জবার পর, তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর এবং তাঁর স্বর্গারোহণ ও পঞ্চাশত্তমীর দিনে তাঁদের উপরে পবিত্র আত্মা অবতীর্ণ হওয়ার পর তাঁরা সুস্পষ্টভাবে ঈশ্বরের ভালবাসা এবং সেই ভালবাসার প্রকৃতি সম্পর্কে ধ্রাণা লাভ করেছিলেন যা তাঁদের পরস্পরের মধ্যে অবশ্যই থাকা আবশ্যক। তখন যোহন তাঁর সহশিষ্যদের বলতে পেরেছিলেন: “তিনি আমাদের নিমিত্তে আপন প্রাণ দিলেন, ইহাতে আমরা প্রেম জ্ঞাত হইয়াছি এবং আমরাও ভ্রাতাদের নিমিত্ত আপন আপন প্রাণ দিতে বাধ্য।” AABen 460.3
পবিত্র আত্মার অবতরণের পর যখন শিষ্যেরা একজন জীবিত ত্রাণকর্তার বার্তা ঘোষণা করছিলেন, তাঁদের একটি মাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা হল, মানুষের পরিত্রাণ। ধার্মিকদের সঙ্গে সহভাগিতার মাধুর্যে তাঁরা আনন্দ করছিলেন। তাঁরা ছিলেণ দয়ালু, সুবিবেচক, আত্মত্যাগী, তাঁরা সত্যের কারণে স্বইচ্ছায় যে কোন ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রতিদিন তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে সেই ভালবাসা প্রকাশ করতেন যা খ্রীষ্ট তাঁদের প্রদর্শন করে আনন্দ লাভ করেছিলেন। নিঃস্বার্থ বাক্য এবং কার্যের দ্বারা অন্যের হৃদয়ে এই ভালবাসা উদ্দীপ্ত করার জন্য তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। AABen 461.1
বিশ্বাসীরা সব সময় এমন ভালবাসা তাদের হৃদয়ে সযতেড়ব লালন করেছিলেন। নূতন আদেশের প্রতি স্বইচ্ছায় বাধ্য হয়ে তাঁরা সামনে অগ্রসর হয়েছিলেন। খ্রীষ্টের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে তারা যুক্ত ছিলেন যে, তাঁরা তাঁর সকল প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের জীবন ত্রাণকর্তার ক্ষমতায় অনেক বড় করে দেখা দিয়েছিল যারা তাঁর ধার্মিকতার দ্বারা নিজেদের যাচাই করতে পেরেছিলেন। AABen 461.2
কিন্তু ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন আসছিল। বিশ্বাসীরা অন্যের দোষ ত্রুটি খুঁজতে শুরু করলেন। ত্রুটিগুলো নিয়ে অধিক চিন্তাভাবনা করে কঠোর সমালোচনাকে স্থান দিয়ে তারা খ্রীষ্টের দৃষ্টি এবং তাঁর ভালবাসা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারা বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে কঠোর অবস্থানে গেলেন। বিশ্বাসের অনুশীলন করার চেয়ে মতবাদের দিকে তারা আরও মনোযোগী হলেন। অন্যদের দোষী সাব্যস্ত করার জন্য তৎপর থাকার কারণে তারা তাদের নিজেদের দোষ ত্রুটিগুলো উপেক্ষা করেছিলেন। তারা ভ্রাতৃপ্রেম হারিয়ে ফেলেছিলেন যা খ্রীষ্ট তাদের আদেশ করেছিলেন এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় ছিল, তারা তাদের ক্ষতি সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন। এটি তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে, সুখ এবং আনন্দ তাদের জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং যা তাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের ভালবাসাকে রুদ্ধ করে দেয় তারা সেই অন্ধকারের দিকে দ্রুত পা ফেলছিলেন। AABen 461.3
যোহন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মন্ডলীর মধ্যে ভ্রাতৃপ্রেম নিষ্প্রভ হয়ে গেছে, তাই এই ভালবাসা বিশ্বাসীদের জীবনে স্থায়ীভাবে থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মন্ডলীর উদ্দেশ্যে লেখা পত্রটি এই চিন্তায় পূর্ণ ছিল। “আইস, আমরা পরস্পর প্রেম করি,” তিনি লিখেছেন, “কারণ প্রেম ঈশ্বরের; এবং যে কেহ প্রেম করে, সে ঈশ্বর হইতে জাত এবং সে ঈশ্বরকে জানে। যে প্রেম করে না, সে ঈশ্বরকে জানে না, কারণ ঈশ্বর প্রেম। আমাদের মধ্যে ঈশ্বরের প্রেম ইহাতেই প্রকাশিত হইয়াছে যে, ঈশ্বর আপনার একজাত পুত্রকে জগতে প্রেরণ করিয়াছেন, যেন আমরা তাঁহার দ্বারা জীবন লাভ করিতে পারি। ইহাতেই প্রেম আছে; আমরা যে ঈশ্বরকে প্রেম করিয়াছিলাম, তাহা নয়; কিন্তু তিনিই আমাদিগকে প্রেম করিলেন, এবং আপন পুত্রকে আমাদের পাপার্থক প্রায়শ্চিত্ত হইবার জন্য প্রেরণ করিলেন। প্রিয়তমেরা, ঈশ্বর যখন আমাদিগকে এমন প্রেম করিয়াছেন, তখন আমরাও পরস্পর প্রেম করিতে বাধ্য।” AABen 462.1
বিশেষ অর্থে যা এই ভালবাসা বিশ্বাসীদের দ্বারা প্রকাশ পাওয়া উচিত সে সম্পর্কে প্রেরিত লিখেছেন, “আবার আমি তোমাদিগকে এক নূতন আজ্ঞা লিখিতেছি, ইহা তাঁহাতে ও তোমাদের মধ্যে সত্য; কারণ অন্ধকার ঘুচিয়া যাইতেছে, এবং প্রকৃত জ্যোতি এখন প্রকাশ পাইতেছে। যে বলে, আমি জ্যোতিতে আছি, আর আপন ভ্রাতাকে ঘৃণা করে, সে এখনও অন্ধকারে রহিয়াছে। যে আপন ভ্রাতাকে প্রেম করে, সে জ্যোতিতে থাকে, এবং তাহার অন্তরে বিঘেড়বর কারণ নাই। কিন্তু যে আপন ভ্রাতাকে ঘৃণা করে, সে অন্ধকারে আছে, এবং অন্ধকারে চলে, আর কোথায় যায় তাহা জানে না, কারণ অন্ধকার তাহার চক্ষু অন্ধ করিয়াছে।” AABen 462.2
“কেননা তোমরা আদি হইতে যে বার্তা শুনিয়াছ তাহা এই, আমাদের পর¯পর প্রেম করা কর্তব্য।” “যে কেহ প্রেম না করে, সে মৃত্যুর মধ্যে থাকে। যে কেহ আপন ভ্রাতাকে ঘৃণা করে, সে নরঘাতক; এবং তোমরা জান, অনন্ত জীবন কোন নরঘাতকের অন্তরে অবস্থিতি করে না। তিনি আমাদের নিমিত্তে আপন প্রাণ দিলেন, ইহাতে আমরা প্রেম জ্ঞাত হইয়াছি; এবং আমরাও ভ্রাতাদের নিমিত্ত আপন আপন প্রাণ দিতে বাধ্য।” AABen 462.3
জগতের বিরোধিতা খ্রীষ্টিয় মন্ডলীকে অত্যন্ত বিপদগ্রস্থ করে, বরং তা করে বিশ্বাসীদের হৃদয়ে পোষণ করা দুষ্টতা এবং সুচিন্তিত পন্থায় ঈশ্বরের কাজের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করা। পরশ্রীকাতরতা, অপরের ছিদ্রান্বেষণ করা, অবিশ্বাস এবং মন্দভাবে সন্দেহ করা ছাড়া এমন আর কোন পথ নেই যার মধ্য দিয়ে সুনিশ্চিতভাবে মানুষের আত্মিক দুর্বলতা ঘটতে পারে। অপরদিকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাক্ষ্য হল যে, ঈশ্বর জগতে তাঁর পুত্রকে পাঠিয়েছেন, যারা তাঁর মন্ডলী গঠন করে যেন তাঁরা প্রভু যীশুর মধ্য দিয়ে ঐক্য স্থাপন করেন এবং বিভিনড়ব স্বভাবের লোকদের মধ্যে সম্মিলন করতে পারেন। এই সাক্ষ্য খ্রীষ্টের অনুসারীদের বহন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এটি যথাযথভাবে করতে হলে তাদের খ্রীষ্টের আদেশের অধীনে থেকে চলতে হবে। তাদের চরিত্র খ্রীষ্টের চরিত্রের অনুরূপ হতে হবে এবং প্রভুর ইচ্ছাই হবে তাদের ইচ্ছা। AABen 463.1
“এক নূতন আজ্ঞা আমি তোমাদিগকে দিতেছি,” খ্রীষ্ট বলছেন, “তোমরা পরস্পর প্রেম কর; আমি যেমন তোমাদিগকে প্রেম করিয়াছি, তোমরাও তেমনি পরস্পর প্রেম কর।” যোহন ১৩:৩৪। কী চমৎকার সাক্ষ্য; কিন্তু আহা, কী দুর্বলভাবেই না আমরা এর অনুশীলন করছি! বর্তমানে খ্রীষ্টিয় মন্ডলীতে এই ভ্রাতৃপ্রেম দুঃখজনকভাবে অভাব দৃষ্ট হচ্ছে। অনেকে আছেন যারা বলে থাকেন যে, তারা ত্রাণকর্তাকে ভালবাসেন, কিন্তু তারা পরস্পরকে ভালবাসেন না। যারা নিজেদের খ্রীষ্টিয়ান বলে দাবী করে থাকেন তাঁদের দিকে অবিশ্বাসীরা এটি দেখার জন্য লক্ষ্য করে যে, আদৌ তাঁদের দাবী করা বিশ্বাসের কোন প্রভাব তাদের ধর্মীয় জীবনের উপর আছে কিনা; তারা দ্রুত চরিত্রের ত্রুটিগুলো নির্ণয় করতে সক্ষম হয়, তারা তাদের আচার ব্যবহারে, কার্যে সামঞ্জস্যহীনতা চিহ্নিত করতে পারে। যারা খ্রীষ্টিয়ান তাদের এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যাতে যারা বিপক্ষ তাদের এই কথা বলা সম্ভব না হয়, দেখ, এই লোকেরা কেমন! এরা খ্রীষ্টের পতাকাতলে অবস্থান করছে অথচ পরস্পরকে ঘৃণা করে। খ্রীষ্টিয়ানদের সকল সদস্যই এক পরিবারভুক্ত, সকল সন্তানদের একই পিতা, তাদের সকলেরই রয়েছে অনন্ত জীবনের প্রত্যাশার একই আশীর্বাদ। বাধন হতে হবে দৃঢ় এবং কোমল যা তাদের পরস্পরকে আবদ্ধ করে রাখবে। AABen 463.2
স্বর্গীয় ভালবাসা হৃদয়ে অত্যন্ত করুণ আকুতি সৃষ্টি করে যখন খ্রীষ্ট যে কোমন সমবেদনা প্রকাশ করেছিলেন সেই একই কোমল সমবেদনা প্রকাশ করতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। যে ব্যক্তির অন্তরে তার ভাইয়ের জন্য নিঃস্বার্থ ভালবাসা রয়েছে বুঝতে হবে ঈশ্বরের জন্য তার যে ভালবাসা রয়েছে তা প্রকৃত ভালবাসা। প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান কখনোই স্বইচ্ছায় জীবনকে বিপদগ্রস্থ করার জন্য সম্মত হবে না এবং অসতর্কভাবে এবং অবহেলায় জীবন যাপন করতে চাইবেন না। তিনি নিজেকে ত্রুটির মধ্যে ধরে রাখবেন না, তিনি তা নিমজ্জিত করতে চাইবেন যাতে পুনর্বার নিরানন্দ এবং নিরুৎসাহ হতে না হয় অথবা শয়তানের যুদ্ধক্ষেত্রে পতিত হতে না হয়। AABen 464.1
যারা কখনোই দয়ালু হৃদয়ের অধিকারী হবার অভিজ্ঞতা লাভ করেনি তারা খ্রীষ্টের জয়কারী ভালবাসা জীবনের উৎসের দিকে অন্যদের চালিত করতে সক্ষম নয়। তার অন্তরে যে ভালবাসা তা হল রুদ্ধ থাকা শক্তি, যা আলাপচারিতায়, স্বেচ্ছাপরায়ণতায়, দয়াপূর্ণ মনোভাবে, যাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে তাদের জীবনের উনড়বতি সাধনের মধ্য দিয়ে তাঁকে প্রকাশ করে। যে সকল খ্রীষ্টিয়ান কার্যকারী এবং তাদের প্রচেষ্টায় সফলতা লাভ করেছেন তারা অবশ্যই খ্রীষ্টের জেনেছেন এবং যথার্থভাবে তাঁকে জানতে পারলে তারা নিশ্চিতভাবে তাঁর ভালবাসাও জানতে পারবেন। খ্রীষ্ট যেভাবে ভালবেসেছেন সেই ভালবাসতে পারার এবং তিনি যেভাবে কাজ করেছেন সেইভাবে কাজ করতে পারার সামর্থের দ্বারা স্বর্গে একজন কার্যকারী হিসেবে তাদের যোগ্যতার পরিমাপ করা হবে। AABen 464.2
“আইস আমরা বাক্যে কিংবা জিহবাতে নয়,” প্রেরিত লিখেছেন, “কিন্তু কার্যে ও সত্যে প্রেম করি।” খ্রীষ্টিয়ানদের চরিত্রের পরিপূর্ণতা অর্জিত হবে তখনই, যখন তার মধ্য থেকে অন্যদের অব্যাহতভাবে সাহায্য করার এবং তাদের আশীর্বাদ করার প্রবণতা সৃষ্টি হতে থাকবে। এটি হল বিশ্বাসীদের বেষ্টন করে থাকা ভালবাসা। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে জীবন থেকে জীবনে প্রবাহিত হওয়া সুগন্ধ স্বরূপ করে এবং তার কাজে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভে যোগ্য প্রতিপনড়ব করে। AABen 464.3
ঈশ্বরের জন্য সর্বোচ্চ ভালবাসা এবং পরস্পরের জন্য নিঃস্বার্থ ভালবাসা — এটি হল শ্রেষ্ঠ দান যা স্বর্গীয় পিতা আমাদের দিতে পারেন। এই ভালবাসা আবেগতাড়িত নয়, কিন্তু এটি ঐশ্বরিক নীতি, একটি চিরস্থায়ী শক্তি। অপবিত্র হৃদয় এই ভালবাসা সৃষ্টি করতে কিংবা উৎপনড়ব করতে সক্ষম নয়। কেবল মাত্র সেই হৃদয়ে যেখানে যীশু রাজত্ব করেন সেখানে এই ভালবাসা খুঁজে পাওয়া যাবে। “আমরা প্রেম করি, কারণ তিনি আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন।” ঐশ্বরিক অনুগ্রহের দ্বারা হৃদয়ে নবায়িত হৃদয়ের ভালবাসা হল মূলনীতির প্রধান বিষয়। এটি চরিত্রকে পরিবর্তিত করে, আবেগকে শাসনে করে, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভালবাসা ও ¯েড়বহ মমতাকে উনড়বত করে। এই ভালবাসা হৃদয়ে লালিত হয়, জীবনকে মধুর করে এবং সর্বত্র নির্মল প্রভাব বিস্তার করে। AABen 464.4
যোহন বিশ্বাসীদের বিশেষ অনুগ্রহ উপলব্ধি করার এবং তা উনড়বত করার জন্য কঠোর পরিশ্র করেছিলেন, যা ভালবাসার শক্তির কার্যের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে এসেছে। এই উদ্ধারকারী শক্তি হৃদয়ে পরিপূর্ণ হলে অন্য সকল উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং জগতের মন্দ প্রভাবের উপরে এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। আর এই রকম ভালবাসা পূর্ণ প্রভাব বিস্তার এবং জীবনে চালিকাশক্তি হিসেবে তারা ঈশ্বরকে তাদের বিশ্বাস ও আস্থার মূল করেন এবং তাদের সঙ্গে তাঁর আচরণের মধ্য দিয়ে তাঁর অনুগ্রহ প্রকাশ পায়। আর এর ফলে তারা বিশ্বাসের পূর্ণ নিশ্চয়তায় তাঁর কাছে আসতে সক্ষম হয়, তারা এই কথা জানতে পারে যে, বর্তমান জগতে এবং পরবর্তী জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারবে। “ইহাতেই প্রেম আমাদের সঙ্গে সিদ্ধ হইয়াছে,” তিনি লিখেছেন, “যেন বিচারদিনে আমাদের সাহস লাভ হয়; কেননা তিনি যেমন আছেন, আমরাও এই জগতে তেমনি আছি। প্রেমে ভয় নাই; বরং সিদ্ধ প্রেম ভয়কে বাহির করিয়া দেয়।” “আর তাঁহার উদ্দেশ্যে আমরা এই যাচ্ঞা করি, তবে তিনি আমাদের যাচ্ঞা শুনেন। আর যদি জানি যে, আমরা যাহা যাচ্ঞা করি, তিনি তাহা শুনেন . . . তবে ইহাও জানি যে, আমরা তাঁহার কাছে যাহা যাচ্ঞা করিয়াছি, সেই সকল পাইয়াছি।” AABen 465.1
“আর যদি কেহ পাপ করে, তবে পিতার কাছে আমাদের এক সহায় আছেন, তিনি ধার্মিক যীশু খ্রীষ্ট। আর তিনি আমাদের পাপার্থক প্রায়শ্চিত্ত, কেবল আমাদের নয়, কিন্তু সমস্ত জগতেরও পাপার্থক।” “যদি আমরা আমাদের আপন আপন পাপ স্বীকার করি, তিনি বিশ্বস্ত ও ধার্মিক, সুতরাং আমাদের পাপ সকল মোচন করিবেন এবং আমাদিগকে সমস্ত অধার্মিকতা হইতে শুচি করিবেন।” ঈশ্বরের কাছ থেকে দয়া লাভের শর্ত খুব সহজ সরল এবং ন্যায্য। ঈশ্বর চান না যে ক্ষমা লাভের জন্য আমরা কষ্টকর এবং কঠিন কোন কাজ করি। আমাদের দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর তীর্থযাত্রার প্রয়োজন নেই অথবা স্বর্গের ঈশ্বরের কাছে আমাদের হৃদয়কে গ্রহণীয় করার জন্য কিংবা আমাদের আদেশ অমান্য করার অন্যায় থেকে মুক্তি লাভের জন্য কষ্টকর প্রায়শ্চিত্তের কাজ সম্পনড়ব করার প্রয়োজন নেই। যে তার পাপ “স্বীকার করিয়া ত্যাগ করে,” “সে করুণা পাইবে।” হিতোপদেশ ২৮:১৩ পদ। AABen 465.2
স্বর্গের আদালতে খ্রীষ্ট তাঁর মন্ডলীর জন্য পক্ষসমর্থন করবেন — তাদের জন্যই পক্ষ সমর্থন করবেন যাদের তিনি নিজ রক্তে মুক্তির মূল্য পরিশোধ করেছেন। শতবর্ষ, যুগসমূহ তাঁর প্রায়শ্চিত্তের উৎসর্গের ফলপ্রসূতা কখনোই শিক্ষা দিতে পারে না। জীবনও নয়, মৃত্যুও নয়, উচ্চতাও নয়, গভীরতাও নয়, কোন কিছুই ঈশ্বরের যে ভালবাসা যীশু খ্রীষ্টের মধ্যে রয়েছে তা থেকে আমাদের পৃথক করতে পারবে না; কারণ এটা নয় যে, আমরা তাঁকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছি, কিন্তু কারণ হল তিনিই আমাদের অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন। যদি আমরা আমাদের পরিত্রাণের জন্য নিজেদের প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করি তাহলে আমরা পরিত্রাণ লাভ করতে পারব না। কিন্তু এটি এমন একজনের উপর নির্ভর করে যিনি সকল প্রতিজ্ঞার পেছনে রয়েছেন। তাঁকে দুর্বল বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর ভালবাসা হল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ভালবাসার মত। এই শর্তে আমরা তাঁর সঙ্গে ঐক্য রক্ষা করছি, যাতে কেউ তাঁর হাত থেকে আমাদের কেড়ে নিতে না পারে। AABen 466.1
এভাবে বছর অতিবাহিত হতে লাগল এবং বিশ্বাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। যোহন ক্রমবর্ধান বিশ্বস্ততার সঙ্গে পরিশ্রম করতে লাগলেন এবং তার ভাইদের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে লাগলেন। মন্ডলীর জন্য সময়টা ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। অশুভ অলীক বিশ্বাস সর্বত্র বিরাজমান ছিল। ভ্রান্তভাবে উপস্থাপনের দ্বারা এবং মিথ্যাকথনের দ্বারা শয়তানের দূত খ্রীষ্টের মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইল। মতভেদ এবং বিরুদ্ধ ধর্মমতের ফলে মন্ডলী বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ল। যারা খ্রীষ্টকে স্বীকার করেছিল তারা দাবী করল যে, তাঁর ভালবাসা ঈশ্বরের আদেশের প্রতি বাধ্যতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। অন্যদিকে অনেকে শিক্ষা দিচ্ছিল যে, যিহূদী রীতিনীতি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা আবশ্যক; খ্রীষ্টের রক্তে বিশ্বাস স্থাপন না করে কেবল আজ্ঞা পালণ করলে পরিত্রাণ লাভের জন্য যথেষ্ঠ হবে। অনেকে এই ধারণা পোষণ করেছিলেন যে, খ্রীষ্ট একন ভাল মানুষ, কিন্তু তারা তাঁর ঈশ্বরত্বকে অস্বীকার করেছিল। যারা নিজেদের ঈশ্বরের একান্ত বাধ্যগত বলে দাবী করত প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল প্রতারক এবং তাদের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা খ্রীষ্টকে এবং তাঁর সুসমাচারকে অস্বীকার করেছিল। তারা আজ্ঞা লঙ্ঘন করে জীবন যাপন করতে গিয়ে মন্ডলীর মধ্যে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে মত প্রবর্তিত করেছিল। এই ভাবে অনেকে সন্দেহবাদের গোলকধাঁধার এবং ভ্রান্তির মধ্যে চালিত হচ্ছিল। AABen 466.2
মন্ডলীর মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা এই সব ক্ষতিকর ভ্রান্তিগুলো দেখে যোহন দুঃখে পূর্ণ হলেন। তিনি মন্ডলীতে বিপজ্জনক বিষয় দেখতে পেলেন যা প্রকাশ পেয়েছিল এবং এই বিষয়ে জরুরিভাবে তৎপর হওয়া ও এর মীমাংসার জন্য পদক্ষেপ নিতে চাইলেন। প্রেরিত যোহন ভালবাসার মানসিকতায় নিঃশ্বাস ফেললেন। এতে মনে হয়েছে যেন তিনি ভালবাসায় ডুবে থাকা কলম দিয়ে লিখেছেন। কিন্তু যখন তিনি তাদের সংস্পর্শে আসলেন যারা ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করেও দাবী করে যে, তারা পাপমুক্ত জীবন যাপন করছেন, তিনি তাদের এই ভয়ঙ্কর প্রতারণার জন্য সতর্ক করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। AABen 467.1
সুসমাচারের কাজে সাহায্যকারী একজন সুখ্যাতিপূর্ণ এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী মহিলার কাছে পত্র লিখতে গিয়ে তিনি বলেছেন: “কারণ অনেক ভ্রামক জগতে বাহির হইয়াছে; যীশু খ্রীষ্ট মাংসে আগমন করিয়াছেন, ইহা তাহারা স্বীকার করে না; ইহা ত সেই ভ্রামক ও খ্রীষ্টারি। আপনাদের বিষয়ে সাবধান হও; আমরা যাহা সাধন করিয়াছি, তাহা যেন তোমরা না হারাও, কিন্তু যেন স¤পূর্ণ পুরস্কার পাও। যে কেহ অগ্রে চলে, এবং খ্রীষ্টের শিক্ষাতে না থাকে, সে ঈশ্বরকে পায় নাই; সেই শিক্ষাতে যে থাকে, সে পিতা ও পুত্র উভয়কে পাইয়াছে। যদি কেহ সেই শিক্ষা না লইয়া তোমাদের কাছে আইসে, তবে তাহাকে বাটীতে গ্রহণ করিও না, এবং তাহাকে ‘মঙ্গল হউক’ বলিও না। কেননা যে তাহাকে ‘মঙ্গল হউক’ বলে, সে তাহার দুষ্কর্ম সকলের সহভাগী হয়।” AABen 467.2
ঈশ্বরের আজ্ঞা অমান্য করে জীবন যাপন করেও যারা দাবী করত যে তারা খ্রীষ্টের সঙ্গে আছে তাদের সম্পর্কে প্রিয় শিষ্য যা করেছেন সেই ভাবে মূল্যায়ন করার অধিকার প্রাপ্ত হয়েছি আমরা। এই শেষ দিনগুলোর বিদ্যমান একই রকম মন্দতা যা তাদের মধ্যেও দৃষ্ট হয়েছিল তা মন্ডলীর সৌভাগ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল; আর এই বিষয়ে প্রেরিত যোহনের শিক্ষাগুলোতে যত্ন সহকারে মনোযোগ দিতে হবে। চারদিকে এই চিৎকার শোনা যাচ্ছে, “তোমার দয়া থাকা উচিত,” বিশেষ করে তাদের কাছ থেকে এই চিৎকার শোনা যাচ্ছে যারা পবিত্রকরণের পন্থা স্বীকার করেছিল। কিন্তু যে পাপ স্বীকার করা হয়নি তা ঢাকার জন্য প্রকৃত দয়ার কাজ আরও পবিত্র। AABen 467.3
যাদের জন্য খ্রীষ্ট জীবন দিয়েছেন সেই ব্যক্তিদের যখন আমরা ভালবাসব তখন আমরা শয়তানের সঙ্গে কোন আপোষ করব না। আমরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে এবং এই দয়ার কাজ করার আহ্বান জানানোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারি না। বর্তমান কালে ঈশ্বর তাঁর লোকদের কাছে এই প্রত্যাশা করেন যেন যোহনের মত আমরাও আত্ম ধ্বংসকারী মন্দ কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়াই। AABen 468.1
প্রেরিত যোহন এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, যে সময় আমরা খ্রীষ্টিয় শিষ্টাচার প্রকাশ করব তখন পাপ এবং পাপীদের সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলার ক্ষমতাও আমাদের দেওয়া হবে, যাতে এটি প্রকৃত শিষ্টাচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন না হয়। “যে কেহ পাপাচারণ করে,” তিনি লিখেছেন, “সে ব্যবস্থা লঙ্ঘন করে, আর ব্যবস্থা লঙ্ঘনই পাপ। আর তোমরা জান, পাপভার লইয়া যাইবার নিমিত্ত তিনি প্রকাশিত হইলেন এবং তাঁহাতে পাপ নাই। যে কেহ তাহাতে থাকে সে পাপ করে না; যে কেহ পাপ করে সে তাহাকে দেখে নাই এবং জানেও না।” AABen 468.2
যোহন কোন বাদানুবাদের মধ্যে যাননি, কোন ক্লান্তিকর কলহের মধ্যেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। তিনি যা জানেন এবং তিনি যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তাই তিনি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর শিক্ষাগুলো শুনেছেন, তাঁর অলৌকিক কাজগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। যোহন যেভাবে খ্রীষ্টের চরিত্রের সৌন্দর্যসমূহ দেখেছেন খুব কম ব্যক্তি তা দেখতে পেয়েছিল। তাঁর জন্য অন্ধকার দূরীভ‚ত হয়েছিল এবং তাঁর উপর প্রকৃত আলো কিরণ দিচ্ছিল। ত্রাণকর্তার জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর সাক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট এবং খুব শক্তিশালী। ত্রাণকর্তার জন্য প্রাচুর্যপূর্ণ উপচে পড়া ভালবাসা দিয়ে তিনি কথা বলেছেন এবং কোন ক্ষমতা তাঁর কথার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। AABen 468.3
“যাহা আদি হইতে ছিল,” তিনি উল্লেখ করেছেন, “যাহা আমরা শুনিয়াছি, যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, যাহা নিরীক্ষণ করিয়াছি এবং স্বহস্তে স্পর্শ করিয়াছি, জীবনের সেই বাক্যের বিষয় (লিখিতেছি)— আর সেই জীবন প্রকাশিত হইলেন, এবং আমরা দেখিয়াছি, ও সাক্ষ্য দিতেছি; . . . আমরা যাহা দেখিয়াছি ও শুনিয়াছি, তাহার সংবাদ তোমাদিগকেও দিতেছি, যেন আমাদের সহিত তোমাদেরও সহভাগিতা হয়। আর আমাদের যে সহভাগিতা, তাহা পিতার এবং তাঁহার পুত্র যীশু খ্রীষ্টের সহিত।” তাই প্রত্যেক প্রকৃত বিশ্বাসী তাঁর নিজ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে “ইহাতে মুদ্রাঙ্ক দিয়াছে যে, ঈশ্বর সত্য।” যোহন ৩:৩৩। যা সে দেখেছে এবং শুনেছে সেই বিষয়ে সে সাক্ষ্য দিতে পারবে এবং খ্রীষ্টের ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারবে। AABen 469.1