পিতৃকুলপতিগণ ও ভাববাদীগণ
৮—প্লাবনের পরে এক নতুন সূচনা
জল উচ্চতম পর্বতেরও উপরে উঠে গেল । আর যখন পাঁচ মাস যাবৎ তাদের জাহাজ চারিদিকে বিক্ষোভিত হচ্ছিল তখন জাহাজের ভিতরের পরিবারের মনে হচ্ছিল যে তারাও ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। এটা খুবই কষ্টকর পরীক্ষা ছিল, কিন্তু নোহের বিশ্বাস এতটুকুও নড়েনি । PPBeng 63.1
যখন জল কমতে আরম্ভ করল, তখন ঈশ্বর জাহাজটিকে কতকগুলি পর্বতের মধ্যে এক স্থানে ভেসে যেতে দিলেন। এই পর্বতগুলি ঈশ্বরের ক্ষমতায় রক্ষা পেয়েছিল । এই গাছগুলি অল্প অল্প দূরত্বে অবস্থিত ছিল, আর এই শান্ত আশ্রয়ে এদিকে ওদিকে যাতায়াত করতে লাগল। এতে শ্রান্ত, ক্লান্ত, বিক্ষুব্ধ যাত্রীদের প্রচুর শান্তি দিল ৷ PPBeng 63.2
নোহ ও তার পরিবার আবার ভূমিতে পা রাখার জন্য আকুল ছিল। পর্বতের চূড়া দেখা যাবার চল্লিশ দিন পর তারা একটি দাঁড় কাককে বাইরে ছেড়ে দিলেন যে এটি ভূমি শুকিয়েছে কিনা তা আবিষ্কার করতে পারে। এই পাখী জল ছাড়া আর কোন কিছু না পেয়ে জাহাজের চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল । সাত দিন পরে একটি কপোতকে পাঠানো হলো, যা পা রাখার কোন স্থান না পেয়ে আবার জাহাজে ফিরে এল। নোহ আরো সাতদিন অপেক্ষা করার পর আবারও কপোতটিকে পাঠালেন। যখন সন্ধ্যার সময় এটি একটি জলপাই গাছের পাতা ঠোঁটে নিয়ে জাহাজে ফিরে এল তখন সকলে খুবই উল্লাসিত হল। তথাপি নোহ যাত্রার জন্য বিশেষ নির্দেশের অপেক্ষা করলেন । PPBeng 63.3
অবশেষে একজন দূত জাহাজের বৃহৎ দরজাটি খুলে দিলেন আর কূলপতিকে তার পরিবারসহ পৃথিবীতে নেমে যেতে বলেলন এবং সমস্ত প্রাণীকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। নোহ তাকে ভুললেন না যার অনুগ্রহ ও যত্নে তারা রক্ষা পেয়েছিলেন। তার প্রথম কাজ ছিল একটি যজ্ঞ বেদী তৈরী করে একটি বলি দেয়া, এবং এর মাধ্যমে তাদের রক্ষার জন্য ঈশ্বরের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ও ক্রুশে হত খ্রীষ্টের উপর তার বিশ্বাসের প্রমাণ করা । এই বলি ঈশ্বরের নিকট খুবই আনন্দদায়ক ছিল, এবং এই অনুগ্রহ শুধুমাত্র কূলপতি ও তার পরিবারের প্রতি নয় কিন্তু পৃথিবীতে যারাই বাস করবে তাদের সকলের প্রতি বর্ষিত হলো। “আর সদাপ্রভু মনে মনে কহিলেন, আমি মানুষের জন্য আর ভূমিকে অভিশাপ দিব না,...যাব পৃথিবী থাকিবে, তাব শস্য বপনের ও শস্য ছেদনের সময়, এবং শীত ও উত্তাপ, এবং গ্রীষ্মকাল ও হেমন্ত কাল, এবং দিবা ও রাত্রি, এই সকলের নিবৃত্তি হইবে না।” নোহ একটি বিরান ভূমিতে অবতরণ করলেন, কিন্তু নিজের জন্য গৃহ তৈরীর আগে, তিনি ঈশ্বরের জন্য যজ্ঞ বেদী তৈরী করলেন। তার পশুপাল খুবই অল্প ছিল, তথাপি সমস্ত কিছুই যে তারই এর স্বীকারোক্তি স্বরূপ তিনি এর (পশু পালের) একটি অংশ ঈশ্বরকে দিলেন। একই ভাবে আমাদের প্রতি তার অনুগ্রহের স্বীকার স্বরূপ আমাদের বাধ্যতা প্রদর্শন করা ও তার কাজে দান করা উচিত। PPBeng 63.4
মেঘধনু- ঈশ্বরের অনুগ্রহের নিদর্শন PPBeng 64.1
পাছে লোকে বন্যার ভয়ে ভীত হয়, ঈশ্বর নোহের পরিবারকে একটি প্রতিজ্ঞা দ্বারা উসাহিত করলেনঃ “আমি তোমাদের সহিত আমার নিয়ম স্থির করি;...পৃথিবীর বিনাশার্থ জলপ্লাবন আর হইবে না।...আমি মেঘে আপন ধনু স্থাপন করি, তাহাই পৃথিবীর সহিত আমার নিয়মের চিহ্ন হইবে। যখন আমি পৃথিবীর ঊর্ধ্বে মেঘের সঞ্চার করিব, তখন সেই ধনু মেঘে দৃষ্ট হইবে; .... আমি তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিব; তাহাতে মাংসময় যত প্রাণী পৃথিবীতে আছে তাহাদের সহিত ঈশ্বরের যে চিরস্থায়ী নিয়ম, তাহা আমি স্মরণ করিব।” PPBeng 64.2
ঈশ্বরের প্রসন্নতা কি মহান ও তাঁর বিপথগামী জীবের প্রতি তার মহানুভূতি কতই না মহান । PPBeng 64.3
এটার অর্থ এ নয় যে তিনি কখনো ভুলে যাবেন না, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র আমাদের ভাষায় কথা বলছেন। যখনই ছেলেমেয়েরা আকাশে মেঘধনুর অর্থ জানতে চাবে, তখন তাদের পিতা মাতারা তাদের বলবে যে ঈশ্বর ধনুটি মেঘে স্থাপন করে আমাদের আশ্বস্ত করছেন যে পৃথিবী আর কোনদিন জলে ডুববে না এবং মানুষের প্রতি ঈশ্বরের প্রেমের সাক্ষা হবে এবং ঈশ্বরের উপর তাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করবে। PPBeng 64.4
স্বর্গে ঈশ্বরের সিংহাসনের চতুর্দিকে মেঘধনুর প্রতীক বিরাজ করে এবং খ্রীষ্টের মাথার চতুর্দিকেও মেঘধনুর প্রতীক রয়েছে । যখন মানুষ তার প্রচন্ড পাপ দ্বারা তার উপর ঈশ্বরের বিচারের আহ্বান জানায়, তখন মুক্তিদাতা মেঘের মধ্যে মেঘধনু এবং ঈশ্বরের ক্ষমতার চতুর্দিকের মেঘধনুর প্রতি নির্দেশ করে অনুতপ্ত পাপীদের জন্য আশীর্বাদ কামনা করেন । PPBeng 64.5
“বস্তুতঃ আমার নিকটে ইহা নোহের জলসমূহের সদৃশ; কারণ আমি যেমন শপথ করিয়াছি যে, নোহের জলসমূহ আর ভূতল প্লাবিত করিবে না, তেমনি এই শপথ করিলাম যে, তোমার প্রতি আর ক্রুদ্ধ হইব না, তোমাকে আর ভর্ৎসনাও করিব না ।...আমার দয়া তোমা হইতে সরিয়া যাইবে না, এবং আমার শান্তি-নিয়ম টলিবে না; যিনি তোমার প্রতি অনুকম্পা করেন, সেই সদাপ্রভু ইহা কহেন ।” যিশাইয় ৫৪:৯, ১০। PPBeng 65.1
যখন নোহ যে সমস্ত শক্তিশালী প্রাণী জাহাজ থেকে বের হল, তাদের দিকে তাকালেন, তখন ঈশ্বর এক দূতের মাধ্যমে এক অভয় বাণী দিলেনঃ “পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী ও আকাশের যাবতীয় পক্ষী তোমাদের হইতে ভীত ও ত্রাসযুক্ত হইবে; সমস্ত ভূচর জীব ও সমুদ্রের সমস্ত মৎস্যশুদ্ধ সে সকল তোমাদেরই হস্তে সমর্পিত। প্রত্যেক গমনশীল প্রাণী তোমাদের খাদ্য হইবে; আমি হরিৎ ওষধির ন্যায় সে সকল তোমাদিগকে দিলাম।” এর আগে ঈশ্বর প্রাণীর মাংস খেতে অনুমতি দেন নি, কিন্তু এখন যখন সমস্ত সবুজ জিনিষ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তখন তিনি যে সমস্ত প্রাণী জাহাজে ছিল তাদের শুচি প্রাণীর মাংস খেতে অনুমতি দিলেন। PPBeng 65.2
মহা বন্যার সময় সমস্ত ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তিত হয়ে গেল। প্রত্যেক জায়গায় মৃত দেহ ছড়ানো ছিল। সদাপ্রভু এগুলোকে ঐ ভাবে থেকে পঁচতে ও আবহাওয়া নষ্ট করতে দিতে পারেন না । এক প্রচন্ড বায়ূ যা জল শুকানোর জন্য আনা হয়েছিল তা আরো প্রচন্ড ভাবে বয়ে ঐ মৃত দেহগুলি উড়িয়ে নিয়ে গেল, _এবং কখনো কখনো ঐ বায়ুর বেগ এত বেশী হলো যে পাহাড়ের চূড়া ও গাছপালা উপড়ে নিয়ে গেল এবং মৃত দেহগুলোর উপর গাছ, পাথর ও মাটি চাপা দিল । এই একই পদ্ধতিতে স্বর্ণ ও রৌপ্য, মূল্যবান কাঠ ও দামী পাথর যা বন্যার আগে পৃথিবীকে মহিমান্বিত করেছিল, তাও হারিয়ে গেল । জলের প্রচন্ড স্রোতধারা এ সমস্ত সম্পদের উপর মাটির পাহাড় ঢেলে দিচ্ছিল, এমন কি এর উপর কোন কোন স্থানে এগুলির উপর পর্বত মালার সৃষ্টি করল । ঈশ্বর দেখলেন যে তিনি যতই পাপী মানব জাতিকে ধন-সম্পদে বিভূষিত করেন, ততই তারা তার দৃষ্টিতে যা পাপের কাজ তাই করে । PPBeng 65.3
যে পর্বতগুলি একদা খুবই সুন্দর ছিল, তা এখন ভঙ্গুর ও এলোপাথাড়িতে পরিণত হল। শৈল শিলা ও বিশাল পাথর ভূপৃষ্ঠের উপর ছড়িয়ে থাকল। যেখানে এক সময় স্বর্ণ, রৌপ্য, ও মূল্যবান ধাতুর প্রাচুর্য ছিল সেখানেই অভিশাপের গভীরতম চিহ্ন দেখা গেল । যে সমস্ত দেশে কোন বসতি ছিল না এবং যেখানে পাপের বোঝা কিছুটা কম ছিল, সেখানে অভিশাপ একটু কম দেখা গেল । PPBeng 65.4
খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আগমনের সময়, অভিশাপের তীব্রতার যে অভিজ্ঞতা মানুষ অদ্যাবধি পায় নি, তার প্রকাশ হবে। আকাশ হতে বজ্র যখন পৃথিবীর আগুনের সাথে মিলবে, তখন পর্বত চুলার মত দাউ দাউ করে জ্বলবে, আর লাভার বন্যায় বাগান ও মাঠ, গ্রাম ও শহর পূর্ণ হয়ে যাবে। প্রত্যেক জায়গায় ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হবে ও লাভা নির্গত হতে থাকবে। PPBeng 66.1
এই ভাবে ঈশ্বর দুষ্টদের পৃথিবী হতে ধ্বংস করবেন। আর যে ভাবে নোহ জাহাজে রক্ষা পেয়েছিলেন, সেই ভাবে ধার্মিকগণ রক্ষা পাবেন। গীতসংহিতায় বলা হয়েছে “হাঁ, সদাপ্রভু তুমিই আমার আশ্রয়, তুমি পরাৎপরকে আপনার বাসস্থান করিয়াছ; তোমার কোন বিপদ ঘটিবে না, কোন উৎপাত তোমার তাম্বুর নিকটে আসিবে না।” গীতসংহিতা ৯১:৯, ১০; ১৪ পদ এবং ২৭:৫ দেখুন । PPBeng 66.2