প্রেরিতগণের কার্য-বিবরণ
১৬শ অধ্যায়—আন্তিয়খিয়ায় সুসমাচার প্রচার
নির্যাতনের শিকার হয়ে শিষ্যরা যিরূশালেম থেকে বিতাড়িত হবার পর প্যালেষ্টাইনের বাইরেও বিভিন্ন ভ‚খন্ডে সুসমাচারের বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল; এবং বিশ্বাসীদের বিভিন্ন ছোট ছোট দল একেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দলবদ্ধভাবে বাস করতে শুরু করলেন। শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ “ফৈনীকিয়া, কুপ্র ও আন্তিয়খিয়া পর্যন্ত চারিদিকে ভ্রমণ করিয়া কেবল যিহূদীদেরই নিকটে বাক্য প্রচার করিতে লাগিল।” তারা সাধারণত শুধুমাত্র যিহূদী ও গ্রীক ভাষাভাষী যিহূদীদের কাছেই সুসমাচার প্রচার করতেন। সে সময় পৃথিবীর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরেই যিহূদীদের একেকটি উপনিবেশ পাওয়া যেত। AABen 127.1
যে সমস্ত স্থানে সুসমাচার সাদরে গৃহীত হওয়ার কথা লেখা আছেতাদের মধ্যে একটি হচ্ছে আন্তিয়খিয়া, যা সে সময় সিরিয়ার রাজধানী ছিল। সে সময় নগরীটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হওয়ায় বহু জাতির মানুষ এখানে বসবাস করতে আসত। এর পাশাপাশি আন্তিয়খিয়া নগরীটি এর মনোরম আবহাওয়া, সুদৃশ্য প্রকৃতি, বিলাসিতা, সংস্কৃতি ও বিনোদনের কারণে অনেকের কাছেই বসবাসের জন্য বেশ আকাক্সিক্ষত স্থান ছিল। প্রেরিতদের যুগে নগরীটি বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল নগরীতে পরিণত হয়েছিল। AABen 127.2
সাইপ্রাস ও সাইরিন (কুপ্র ও কুরীণ) থেকে আগত কয়েকজন শিষ্য আন্তিয়খিয়ায় প্রকাশ্যে সুসমাচার প্রচার করেছিলেন, যারা “প্রভু যীশুর বিষয়ে সুসমাচার প্রচার করিল।” “প্রভুর হস্ত তাহাদের সহবর্তী ছিল” এবং তাদের একাগ্র শ্রম ফল বয়ে এনেছিল। এ কারণেই “বহুসংখ্যক লোক বিশ্বাস করিয়া প্রভুর প্রতি ফিরিল।” AABen 127.3
“তাহাদের বিষয় যিরূশালেমস্থ মন্ডলীর কর্ণগোচর হইল; তাহাতে ইঁহারা আন্তিয়খিয়া পর্যন্ত বার্ণবাকে প্রেরণ করিলেন।” নতুন কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ কারণ তারা কেবল স্বীষ্টকেই প্রচার করতেন এবং তার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের কাছে তাদের প্রার্থনা উপস্থাপন করতেন। করে বার্ণবা দেখলেন স্বর্গীয় অনুগ্রহের দ্বারা ইতোমধ্যে সেই কাজ সম্পনড়ব হয়েছে। তিনি “আনন্দ করিলেন; এবং সকলকে আশ্বাস দিতে লাগিলেন, যেন তাহারা হৃদয়ের একাগ্রতায় প্রভুতে স্থির থাকে।” AABen 127.4
আন্তিয়খিয়ায় বার্ণবার শ্রম দারুনভাবে আশীর্বাদ পেয়েছিল এবং অনেকেই সেখানে বিশ্বাসী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানকার কাজে অগ্রগতি আসার পর বার্ণবা অনুভব করলেন ঈশ্বরের আশীর্বাদের দ্বারা আরও বেশি করে উন্মোচিত করার জন্য তাঁর প্রয়োজন উপযুক্ত সহযোগিতা। আর তাই তিনি তার্ষে পৌলের খোঁজে গেলেন, যিনি যিরূশালেম ত্যাগ করার পর কিছুদিন সেখানে অবস্থান করছিলেন এবং “সুরিয়ার ও কিলিকিয়ার অঞ্চলসমূহে” সেই বিশ্বাসের বার্তা প্রচার করছিলেন, “যাহা পূর্বে উৎপাটন” করা হয়েছিল, গালাতীয় ১:২১, ২৩। বার্ণবা পৌলকে খুঁজে পেলেন এবং তাঁকে তাঁর পরিচর্যা কাজে সঙ্গী হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। AABen 128.1
জনবহুল আন্তিয়খিয়া নগরীতে পৌল আরেকটি বড় কাজের ক্ষেত্র খুঁজে পেলেন। তাঁর শিক্ষা, জ্ঞান ও একাগ্রতা সংস্কৃতিমনা এই নগরীর অধিবাসী ও আগত পর্যটকদের অন্তরে এক দারুন প্রভাব ফেলেছিল। প্রায় এক বছর ধরে এই দুই শিষ্য বিশ্বস্তভাবে পরিচর্যা কাজ করলেন এবং বহু মানুষকে নাসরতীয় যীশু খ্রীষ্টের, এই জগতের ত্রাণকর্তার বার্তা প্রদান করলেন। AABen 128.2
আন্তিয়খিয়াতেই শিষ্যদেরকে প্রথম খ্রীষ্টিয়ান নামে সম্বোধন করা হয়। তাঁদের প্রচার, শিক্ষা ও সমস্ত কথোপকথনের মূল বক্তব্য ছিলেন খ্রীষ্ট, এ কারণেই তাদেরকে এই নাম দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সব সম থেকে আশীর্বান্বিত হতেন। অক্লান্তভাবে তারা খ্রীষ্টের শিক্ষা ও তাঁর সুস্থতা দানের আশ্চর্য কাজের পুনরাবৃত্তিতে নিজেদেরকে মগড়ব রাখতেন। কম্পিত ওষ্ঠ ও অশ্রæভেজা চোখে তাঁরা গেৎশিমানী উদ্যানে তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, তাঁর বিচার ও মৃত্যুর কথাগুলো বলেছেন। সেই সাথে বলেছেন খ্রীষ্টের অসীম সহিষ্ণুতা এবং নম্রতার কথা, যা তিনি তাঁর বিপক্ষের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হওয়ার সময়ও ধরে রেখেছেন এবং যারা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করছিল ও যন্ত্রণা দিচ্ছিল তাদের প্রতি তিনি ঈশ্বরতুল্য করুণা করেছেন। তাঁর পুনরুত্থান ও স্বর্গারোহণ এবং স্বর্গে মানুষের জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর কাজের কথা ভেবে তাঁরা আনন্দে সময় অতিবাহিত করতেন। পরজাতীয়েরা তাদেরকে খ্রীষ্টিয়ান বলে সম্বোধন করে উপযুক্ত কাজই করেছে, কারণ তাঁরা কেবল খ্রীষ্টকেই প্রচার করতেন এবং তাঁর মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের কাছে তাদের প্রার্থনা উপস্থাপন করতেন। AABen 128.3
ঈশ্বরই তাদেরকে খ্রীষ্টিয়ান নামটি দিয়েছিলেন। এটি ছিল অত্যন্ত রাজকীয় একটি নাম, যা খ্রীষ্টের সাথে যুক্ত হওয়া প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল। এই নামটিই যাকোব তাঁর পত্রে লিখেছিলেন, “ধনবানেরাই কি তোমাদের প্রতি উপদ্রব করে না? তাহারাই কি তোমাদিগকে টানিয়া বিচার—স্থানে লইয়া যায় না? যে উত্তম নাম তোমাদের উপরে কীর্তিত হইয়াছে, তাহারাই কি সেই নামের নিন্দা করে না?” যাকোব ২:৬,৭। অন্যদিকে পিতর ঘোষণা করেছেন, “কিন্তু যদি কেহ খ্রীষ্টীয়ান বলিয়া দুঃখভোগ করে, তবে সে লজ্জিত না হউক; কিন্তু এই নামে ঈশ্বরের গৌরব করুক।” “তোমরা যদি খ্রীষ্টের নাম প্রযুক্ত তিরস্কৃত হও, তবে তোমরা ধন্য; কেননা প্রতাপের আত্মা, এমন কি, ঈশ্বরের আত্মা তোমাদের উপরে অবস্থিতি করিতেছেন।” ১ পিতর ৪:১৬,১৪। AABen 129.1
আন্তিয়খিয়ার বিশ্বাসীরা অনুভব করেছিলেন যে, ঈশ্বর তাদের জীবনে কার্যকর হতে চাইছিলেন, “কারণ ঈশ্বরই আপন হিতসঙ্কল্পের নিমিত্ত তোমাদের অন্তরে ইচ্ছা ও কার্য উভয়ের সাধনকারী।” ফিলিপীয় ২:১৩। তারা এমন একদল মানুষের মাঝে বাস করছিলেন যাদের কাছে চিরন্তন মূল্যবান বস্তুর ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহই নেই। এই বিশ্বাসীরা নিজেদের অন্তরের শুদ্ধতার মাধ্যমে এবং যাকে তারা ভালবাসেন ও সেবা করেন সেই খ্রীষ্টের বিষয়ে সাক্ষ্য তুলে ধরার মাধ্যমে এই সব লোকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন।তাদের বিনম্র পরিচর্যা কাজের মধ্য দিয়ে তারা জীবনদায়ী বাক্যকে আরও কার্যকর করে তোলার জন্য পবিত্র আত্মার শক্তির উপরে নির্ভর করতে শিখেছেন। আর তাই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রতিদিন খ্রীষ্টেতে তাদের বিশ্বাসের সাক্ষ্য দিয়েছেন। AABen 129.2
আন্তিয়খিয়ায় খ্রীষ্টিয়ানদের দৃষ্টান্ত আজকের বিশ্বের প্রত্যেকটি বড় বড় শহরে বসবাসকারী খ্রীষ্টিয়ানদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করা উচিত।ঈশ্বরের আদেশেই তাঁর মনোনীত কার্যকারীরা পবিত্র হয়ে ও তালন্ত নিয়ে বিভিন্ন প্রধান প্রধান জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে গিয়ে প্রচার কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন। তিনি এটাও চেয়েছেন যেন এই সব শহরে বসবাসকারী বিশ্বাসীরা আত্মা জয়ের জন্য তাদের ঈশ্বর প্রদত্ত তালন্ত ব্যবহার করেন। যারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমর্পণ করবে তারা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রজ্ঞার সাথে পদক্ষেপ রাখতে সক্ষম হবে। AABen 129.3
আজকের পৃথিবীতে ঈশ্বর বাইবেলীয় সত্যের জীবন্ত প্রতিনিধি চান। অভিষিক্ত পরিচর্যাকারীরাই কেবল বড় বড় শহরগুলোর মানুষদেরকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নন। ঈশ্বর শুধুমাত্র পরিচর্যাকারীদেরকেই আহ্বান জানাচ্ছেন না, উপরন্তু তিনি চিকিৎসক, নার্স, পুস্তিকা বিতরণকারী, বাইবেল শিক্ষাকর্মী সহ মন্ডলীর সমস্ত সাধারণ সদস্যদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন যাদের ঈশ্বরের বাক্য সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে এবং যারা তাঁর অনুগ্রহের শক্তি সম্পর্কে জানেন, এবং যেসব নগরীকে সাবধান করা হয়নি তাদের কী ধরনের পরিণতি হতে পারে সে সম্পর্কেও জানেন। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে এবং অনেক কিছু করার রয়েছে। প্রত্যেক প্রতিনিধিকেই কাজে নামতে হবে, যেন বর্তমানে যে সুযোগ রয়েছে তা বিজ্ঞতার সাথে সদ্ব্যবহার করা যায়। AABen 130.1
বার্ণবার সাথে আন্তিয়খিয়ায় পৌলের পরিচর্যা কাজ তাঁকে এই কথা বিশ্বাস করতে শক্তি যুগিয়েছিল যে, ঈশ্বরই তাঁকে অযিহূদীদের মধ্যে বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেছেন। পৌলের মন পরিবর্তনের সনময় প্রভু এ কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তাঁর অযিহূদীদের কাছে পরিচর্যাকারী করা হবে, “যেন তুমি তাহাদের চক্ষু খুলিয়া দেও, যেন তাহারা অন্ধকার হইতে জ্যোতির প্রতি, এবং শয়তানের কর্তৃত্ব হইতে ঈশ্বরের প্রতি ফিরিয়া আইসে, যেন আমাতে বিশ্বাস করণ দ্বারা পাপের মোচন ও পবিত্রীকৃত লোকদের মধ্যে অধিকার প্রাপ্ত হয়।” প্রেরিত ২৬:১৮। অননিয়ের কাছে যে স্বর্গদূত এসেছিলেন তিনি পৌল সম্পর্কে বলেছিলেন, “জাতিগণের ও রাজগণের এবং ইস্রায়েল—সন্তানগণের নিকটে আমার নাম বহনার্থে সে আমার মনোনীত পাত্র।” প্রেরিত ৯:১৫। পৌল নিজেও পরবর্তীতে যিরূশালেমের ধর্মধামে প্রার্থনা করার সময় ঈশ্বরের কাছ থেকে একটি দর্শন পান এবং সেখানে ঈশ্বর তাঁকে বলেন, “প্রস্থান কর, কেননা আমি তোমাকে দূরে পরজাতিগণের কাছে প্রেরণ করিব।” প্রেরিত ২২:২১। AABen 130.2
এভাবেই প্রভু পৌলকে অযিহূদীদের জগতে আরও বড় পরিসরে পরিচর্যা কাজের জন্য আদেশ দিলেন। তাঁকে এই ব্যাপক ও জটিল কাজের ভার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে তুলতে ঈশ্বর তাকে তাঁর নিজের সাহচার্যে রাখলেন এবং তাঁর সামনে দর্শনের মধ্য দিয়ে স্বর্গের অনুপম সৌন্দর্যময় ও মহিমান্বিত দৃশ্য উন্মোচন করলেন। তাঁকে সেই “নিগূঢ় রহস্য” জানানোর পরিচর্যা কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল যা “অনাদিকাল অবধি অকথিত ছিল” (রোমীয় ১৬:২৫), — “আপন ইচ্ছার নিগূঢ়তত্ত¡” (ইফিষীয় ১:৯), “বিগত পুরুষপর¤পরায় সেই নিগূঢ়তত্ত¡ মনুষ্য—সন্তানদিগকে এইরূপে জ্ঞাত করা যায় নাই, যেরূপে এখন আত্মাতে তাঁহার পবিত্র প্রেরিত ও ভাববাদিগণের নিকটে প্রকাশিত হইয়াছে। ফলতঃ সুসমাচার দ্বারা খ্রীষ্ট যীশুতে পরজাতীয়েরাও সহদায়াদ, দেহের সহাঙ্গ ও প্রতিজ্ঞার সহভাগী হয়; ঈশ্বরের অনুগ্রহের যে দান তাঁহার শক্তির কার্যসাধন অনুসারে আমাকে দত্ত হইয়াছে,” প্রেরিত পৌল ঘোষণা করছেন, “তদনুসারে আমি সেই সুসমাচারের পরিচারক হইয়াছি।আমি সমস্ত পবিত্রগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম হইলেও আমাকে এই অনুগ্রহ দত্ত হইয়াছে, যাহাতে পরজাতিদের কাছে আমি খ্রীষ্টের সেই ধনের বিষয়ে সুসমাচার প্রচার করি, যে ধনের সন্ধান করিয়া উঠা যায় না;এবং যাহা আদি অবধি সমুদয়ের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের কাছে গুপ্ত থাকিয়া আসিয়াছে, সেই নিগূঢ়তত্ত্বের বিধান কি, তাহা প্রকাশ করি;উদ্দেশ্য এই, যেন এখন মন্ডলী দ্বারা স্বর্গীয় স্থানস্থ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব সকলকে ঈশ্বরের বহুবিধ প্রজ্ঞা জ্ঞাত করা যায়,যুগপর্যায়ের সেই সঙ্কল্প অনুসারে যে সঙ্কল্প তিনি আমাদের প্রভু খ্রীষ্ট যীশুতে করিয়াছিলেন।” ইফিষীয় ৩:৫—১১। AABen 130.3
পৌল ও বার্ণবার যে সময়টা আন্তিয়খিয়ায় বিশ্বাসীদের সাথে কাটিয়েছিলেন, সে সময় তাদের কৃত পরিচর্যা কাজকে ঈশ্বর প্রচুররূপে আশীর্বাদ করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই তখনো সুসমাচারের পরিচর্যা কাজে আনুষ্ঠানিক অভিষেক পাননি। তাঁরা এখন তাঁদের খ্রীষ্টিয় অভিজ্ঞতার এমন এক স্থানে পৌঁছেছেন যখনঈশ্বর তাঁদের উপরে ভরসা করে আরও কঠিন এক পরিচর্যা কাজের দায়িত্ব তাদেরকে দিতে চলেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁরা মন্ডলীর পক্ষে এক অভ‚তপূর্ব সাফল্য অর্জন করবেন। AABen 131.1
“তখন আন্তিয়খিয়ার মন্ডলীতে বার্ণবা, শিমোন, যাঁহাকে নীগের বলে, কুরীণীয় লুকিয়, হেরোদ রাজার সহপালিত মনহেম, এবং শৌল নামে কয়েক জন ভাববাদী ও শিক্ষক ছিলেন।তাঁহারা প্রভুর সেবা ও উপবাস করিতেছিলেন, এমন সময়ে পবিত্র আত্মা কহিলেন, আমি বার্ণবা ও শৌলকে যে কার্যে আহ্বান করিয়াছি, সেই কার্যের নিমিত্ত আমার জন্য এখন তাহাদিগকে পৃথক করিয়া দেও। পরজাতীয়দের জগতে বাক্যের প্রচারক হিসেবে প্রেরিত হওয়ার আগে তাঁরা উপবাস ও প্রার্থনা এবং হস্তার্পণের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। এভাবে তাঁরা মন্ডলী কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত হলেন, তবে শুধুমাত্র সত্যের বাক্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য নয়, সেই সাথে বাপ্তিস্ম দান এবং নতুন মন্ডলী স্থাপনের জন্যও, যে উদ্দেশ্যে তাদেরকে পূর্ণ পালকীয় পরিচর্যার কর্তৃত্ব দান করা হয়েছিল। AABen 131.2
এই সময় খ্রীষ্টিয় মন্ডলী এক গুরুত্বপূর্ণ যুগে পদার্পণ করে। পরজাতীয়দের মধ্যে এখন সাহসের সাথে সুসমাচারের বাক্য প্রচার করা হবে এবং এর ফলে মন্ডলী বহু আত্মার সমাগমে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। যে প্রেরিতগণকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে তাদেরকে সন্দেহ করা হয়েছে, তাদেরকে ভুল বোঝা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ঈর্ষাও করা হয়েছে। যে “মধ্যবর্তী বিচ্ছেদের দেওয়াল” (ইফিষীয় ২:১৪) বহু দিন ধরে যিহূদী ও পরজাতীয়দের মধ্যে এক বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছিল সেটি ভেঙে ফেলার জন্য পৌল ও বার্ণবা যে শিক্ষা দান করছিলেন তা খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাসী যিহূদীদের চোখে তাঁদেরকে অপরাধী করে তুলেছিল। বহু ধর্মভীরু বিশ্বাসী যিহূদীদের কাছে সুসমাচারের পরিচর্যাকারী হিসেবে তাঁদের যথাযোগ্যতা প্রশেড়বর সম্মুখীন হয়েছিল। ঈশ্বর দেখেছিলেন যে, তাঁর শিষ্যরা কী ধরনের সমস্যায় পড়ছেন এবং সেই বাধাগুলোকে যেন তারা সহজে অতিক্রম করতে পারেন সেজন্য তিনি প্রত্যাদেশের মধ্য দিয়ে মন্ডলীকে এই নির্দেশনা দিলেন যেন তারা প্রকাশ্যে তাঁদেরকে সুসমাচারের পরিচর্যার কাজে প্রেরণ করার জন্য অভিষেক দান করেন। তাঁরা যে পরজাতীয়দের কাছে সুসমাচারের আলোকবর্তিকা বহন করার জন্য ঈশ্বরের কাছ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন সেটি জনসম্মুখে প্রকাশ করাই ছিল এই অভিষেকের উদ্দেশ্য। AABen 132.1
পৌল এবং বার্ণবা দুজনেই ইতোমধ্যে স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে তাঁদের অভিষেক লাভ করেছিলেন এবং এতে করে যে তাঁরা কোন নতুন অনুগ্রহ বা গুণাবলী অর্জন করেছিলেন তা নয়। তবে তাঁরা যে অভিষেক লাভ করেছেন সেটি এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সকলের সাক্ষাতে প্রকাশ করা হল এবং তাঁদের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এর মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের পরিচর্যা কাজে মন্ডলীর সীলমোহর দেওয়া হল। AABen 132.2
যিহূদীদের কাছে এই আনুষ্ঠানিকতা বেশ তাৎপর্য বহন করেছিল। একজন যিহূদী পিতা যখন তার সন্তানকে আশীর্বাদ করেন তখন তিনি তার ডান হাত সন্তানের মাথার উপরে রাখেন। একটি প্রাণীকে যখন উৎসর্গের জন্য বলি দেওয়া হয় তখন তার উপরে যাজক হস্তার্পণ করতেন। যখন আন্তিয়খিয়া মন্ডলীর বিশ্বাসীরা পৌল ও বার্ণবার উপরে হস্তার্পণ করলেন তখন তারা মূলত এই কাজের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কাছে যাচ্ঞা করলেন যেন তিনি তাদেরকে এই কাজে তাঁদেরকে তাঁর মনোনীত প্রেরিত হিসেবে আশীর্বাদ করেন। AABen 132.3
পরবর্তীতে কোন এক সময় হস্তার্পণের আনুষ্ঠানিকতাটিকে দারুনভাবে অপব্যবহার করা শুরু হয়। অপ্রয়োজনীয় কাজেও হস্তার্পণ করা হত এই ভেবে যে, হস্তার্পণ করা মানেই যে কারও হাত থেকে ক্ষমতা নির্গত হওয়া, যার ফলে যে কেউ নিজেকে যে কারও কাছে একজন প্রেরিত বা পরিচর্যাকারী বলে দাবী করতে শুরু করেছিল। তবে এই দুই প্রেরিতকে পৃথক করে দেওয়ার বিষয়ে এমন কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, হস্তার্পণের কারণে কোন ধরনের বিশেষ ক্ষমতা তারা নতুন করে লাভ করেছেন। এখানে শুধুমাত্র তাদের আনুষ্ঠানিক অভিষেক ও তাদের ভবিষ্যৎ কাজের জন্য স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। AABen 133.1
পবিত্র আত্মার মধ্য দিয়ে পৌল ও বার্ণবাকে এই নির্দিষ্ট পরিচর্যা কাজের জন্য পৃথক করে দেওয়ার প্রেক্ষাপটটি স্পষ্টভাবে এই বিষয় প্রকাশ করে যে, প্রভু তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্ডলীগুলোতে তাঁর প্রতিনিধিদেরকে দায়িত্বে নিযুক্ত রেখেছেন।কয়েক বছর আগে পৌল সম্পর্কে ঈশ্বরের পরিকল্পনা যখন ত্রাণকর্তার মধ্য দিয়ে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল তখন পৌল তাৎক্ষণিকভাবে দম্মেশকের নবগঠিত মন্ডলীর সদস্যদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। উপরন্তু মন পরিবর্তনকারী ফরীশীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রত্যাদেশ পাওয়ার কারণে উক্ত মন্ডলীটি আর অন্ধকারে পড়ে থাকেনি। আর এখন পবিত্র আত্মার পরিপূর্ণ পরিচালনায় পৌল হয়েছেন পরজাতীয়দের কাছে সুসমাচার প্রচারের প্রধান কান্ডারি, সেই সাথে মন্ডলী স্থাপন ও সহযোগীদের অভিষেক দানের কর্তৃত্বও তাঁকে প্রদান করা হয়েছে। আন্তিয়খিয়া মন্ডলীর নেতৃবর্গ “প্রভুর সেবা ও উপবাস করিতেছিলেন, এমন সময়ে পবিত্র আত্মা কহিলেন, আমি বার্ণবা ও শৌলকে যে কার্যে আহ্বান করিয়াছি, সেই কার্যের নিমিত্ত আমার জন্য এখন তাহাদিগকে পৃথক করিয়া দেও।” AABen 133.2
ঈশ্বর তাঁর মন্ডলীকে এই পৃথিবীতে তাঁর জ্যোতির প্রবাহ হিসেবে গঠন করেছেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর পরিকল্পনা ও ইচ্ছেগুলো জানিয়ে থাকেন। তিনি আর তাঁর কোন একজন পরিচর্যাকারীকে বিশেষ অভিজ্ঞতা দান করেন না, বরং সমগ্র মন্ডলীকে সেই বিশেষ অভিজ্ঞতা ও আশীর্বাদ দান করেন। তিনি পুরো মন্ডলীকে তথা খ্রীষ্টের দেহকে অন্ধকারে রেখে কেবল একজন ব্যক্তিকে আলোকিত করেন না। তিনি তাঁর শাসনের অধীনে তাঁর প্রত্যেক সেবককে তাঁর মন্ডলীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত রেখে এমনভাবে স্থাপন করেন যেন প্রত্যেকে নিজেদের প্রতি যতটা আত্মবিশ্বাস অনুভব করে তার চেয়েও বেশি অন্যদের প্রতি আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে পারে। AABen 133.3
মন্ডলীতে অনেক সময় এমনও হয়েছে যখন সদস্যরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য প্রবলভাবে প্ররোচিত হয়েছেন। তারা এ কথা বুঝতে পারেননি যে, আত্মার স্বাধীনতার ফলে মানুষ নিজের উপরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে এবং এতে করে তারা তাদের ভাইদের, বিশেষ করে ঈশ্বর তাঁর লোকদের উপরে নেতৃত্ব দানের জন্য যাদেরকে নিযুক্ত করেছেন সেই পদস্থ ব্যক্তিদের সুবিজ্ঞ বিচার উপেক্ষা করে নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধির উপরে নির্ভর করতে শুরু করে।ঈশ্বর তাঁর মন্ডলীকে বিশেষ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছেন যেন কেউ অন্যকে অবজ্ঞা বা অসম্মান করতে না পারে, কারণ যে এই কাজ করে সে ঈশ্বরের বাক্যের অবজ্ঞা করে। AABen 134.1
যারা নিজেদের বিচার বুদ্ধিকেই শিরোধার্য বলে মনে করে তারা মহা বিপদের মুখে রয়েছে। শয়তান সব সময় চেষ্টা করে যেন সে জ্যোতিতে অবস্থান করতে থাকা একজনকেও অন্তত সেখান থেকে পৃথক করে নিতে পারে, যাদের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর এই পৃথিবীতে তাঁর রাজ্যকে বৃদ্ধি দান করছেন এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে দায়িত্বশীলতার সাথে নেতৃত্ব দানের জন্য ঈশ্বর যাদেরকে নিযুক্ত করেছেন তাদেরকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করার অর্থ হল ঈশ্বরের আশীর্বাদের বাহনকে অস্বীকার করা ও দূরে সরিয়ে দেওয়া। প্রভু তাঁর প্রজ্ঞা দ্বারা মন্ডলীর সভ্যসভ্যাদের জন্য এমন একটি সংগঠন সৃষ্টি করেছেন যেখানে তারা সবাই একত্রে ঘনিষ্ঠভাবে সহাবস্থান করবে, খ্রীষ্টিয়ানরা অপর খ্রীষ্টিয়ানদের সাথে এবং একটি মন্ডলী অপরাপর মন্ডলীর সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। এভাবেই মানুষের মধ্য দিয়ে ঐশ্বরিক সত্তার সংযোগ সাধিত হয়। ঈশ্বরের প্রত্যেক প্রতিনিধিই পবিত্র আত্মার অধীনে অবস্থান করবে এবং সমস্ত বিশ্বাসী ঈশ্বরের অনুগ্রহের মঙ্গল সুসমাচার পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একযোগে ও ঐক্যের সাথে সামনে এগিয়ে যাবে। AABen 134.2
এই আনুষ্ঠানিক অভিষেককে পৌল তাঁর পরিচর্যার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই সময় থেকে মূলত তিনি খ্রীষ্টের মন্ডলীর পক্ষে তাঁর প্রৈরিতিক পরিচর্যার সূচনা হিসেবে গণ্য করেছেন। আন্তিয়খিয়াতে যখন সুসমাচারের আলো উজ্জ্বল জ্যোতি ছড়াচ্ছিল, তখন যিরূশালেমে অবস্থানরত প্রেরিতরাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন। প্রতি বছর ধর্মীয় উৎসবের সময় সারা দেশ থেকে বহু যিহূদী ধর্মাবলম্বী যিরূশালেমের পবিত্র ধর্মধামে উপাসনা করতে আসতেন। এই তীর্থযাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তারা সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী খুব ভালভাবে জানতেন। তারা ইস্রায়েলর প্রত্যাশা, প্রতিজ্ঞাত মশীহের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। পুরো যিরূশালেম যখন পর্যটকে ভরে যেত তখন প্রেরিতরা অসম সাহস নিয়ে খ্রীষ্টকে প্রচার করতেন, যদিও তাঁরা জানতেন যে এই কাজ করার কারণে তাদের জীবন মহা দুর্বিপাকে পড়তে পারে। ঈশ্বরের আত্মা তাঁর সেবকদের সর্বাঙ্গে মূদ্রিত ছিল; অনেকেই বিশ্বাসে মন পরিবর্তন করেছিল; আর তারা যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের গৃহে ফিরে গিয়েছিল, সাথে করে সমস্ত জাতির ও সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সুসমাচার বীজ সাথে করে নিয়েছিল। AABen 135.1
এই প্রচার কাজে যুক্ত ছিলেন পিতর, যাকোব ও যোহনের মত বিখ্যাত প্রেরিতগণ, যাদের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বর তাদেরকে নিজ নিজ গৃহে ও দেশে খ্রীষ্টের পক্ষে সুসমাচার প্রচারক হিসেবে ব্যবহার করবেন। বিশ্বস্ততার সাথে ও বিজ্ঞতার সাথে তাঁরা পরিচর্যা করেছেন, তাঁরা যে সব ঘটনা দেখেছেন ও শুনেছেন সেগুলোর সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য দিয়ে “ভাববাণীর বাক্য দৃঢ়তর হইয়া” প্রকাশ পেয়েছে (২ পিতর ১:১৯), যেন “ইস্রায়েলের সমস্ত কুল নিশ্চয় জ্ঞাত হউক যে, যাঁহাকে তোমরা ক্রুশে দিয়াছিলে, সেই যীশুকেই ঈশ্বর প্রভু ও খ্রীষ্ট উভয়ই করিয়াছেন” (প্রেরিত ২:৩৬)। AABen 135.2