মণ্ডলীর জন্য উপদেশ

12/327

১ম অধ্যায়

বিশ্বাসীগণের পুরস্কার সম্পর্কীয় দর্শন

(আমার প্রথম দর্শন)

পারিবারিক উপাসনায় আমি যখন প্রার্থনা করিতেছিলাম, তখন আমার উপরে পবিত্র আত্মা পতিত হইলেন। আমার বোধ হইল, আমি অন্ধকার পৃথিবী হইতে বহুদূরে উর্দ্ধ হইতে উর্দ্ধতর দিকে গমন করিতেছি। খ্রীষ্টের আগমনের আকাঙ্ক্ষীদিগের অনুসন্ধানের জন্য আমি জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাদিগকে দেখিতে পাইলাম না বটে; কিন্তু তখন এই বলিয়া যেন একটী বাণী হইল, “পুনরায় আক্তু উর্দ্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর।” তদনুসারে আমি উর্দ্ধ দিকে দৃষ্টিপাত করিবামাত্র একটী সংকীর্ণ সরল রাস্তা দেখিতে পাইলাম। আমি দেখিলাম, খ্রীষ্টের আগমনের আকাঙ্ক্ষিতগণ সেই রাস্তার অপর প্রান্তস্হিত নগরী অভীমুখে গমন করিতেছিলেন। তাঁহারা যাহাতে অন্ধকারে উছোট খাইয়া পড়িয়া না যান, এই জন্য তাঁহাদের পশ্চাতে রাস্তার আরম্ভেই একটী উজজ্বল আলোকে স্থাপিত ছিল। সেই আলোকটীতে সমস্ত রাস্তা আলকিত হইতেছিল। এই আলোকটীর বিষয় আমাকে একটি স্বর্গদূত বলিয়াছিলেন যে, উহা মধ্যরাত্রির উচ্চরব। যীশু তাঁহাদিগকে পশ্চাতে লইয়া নগরী অভিমুখে গমন করিতেছিলেন। সুতরাং তাঁহাদিগের দৃষ্টি যীশুর উপর নিবদ্ধ থাকিলে তাঁহারা যে নিরাপদে নগরীতে পৌঁছিতে পারিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কয়েকজন শীঘ্র ক্লান্ত হইয়া বলিলেন যে, নগর বহুদুর। তাঁহারা ইতঃপূর্ব্বেই নগরে প্রবেশ করিতে পারিবেন বলিয়া আশা করিয়াছিলেন। তখন যীশু আপন উজজল দক্ষিন বাহু উত্তোলন করিয়া তাঁহাদিগকে উৎসাহিত করিলেন, আর ঠিক্ সেই সময় তাঁহার বাহু হইতে একটি আলোক রেখা তাঁহাদিগের উপর পতিত হইল। তখন তাঁহারা আনন্দিত হইয়া “হাল্লিলুয়া” জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষ বিবেচনা না করিয়াই আলকের বিষয় একেবারে অস্বীকার করিলেন; শুধু তাহাই নহে, তাহাদিগকে যিনি এতদূর চালিত করিয়াছেন, তিনি যে ঈশ্বর নহেন, তাহাও বলিতে সঙ্কোচ বোধ করিলেন না। তখন আকস্মাৎ পশ্চাতের আলোটি নিভিয়া যাওয়ায় তাঁহারা ঘোর অন্ধকারে নিপতিত হইলেন। তাঁহাদের পদস্থলন হইতে লাগিল এবং গন্তব্যস্থল ও যীশুর দর্শন হারাইয়া তাঁহারা পথভ্রষ্ট হইয়া নিম্নে অন্ধকার ও পাপময় পৃথিবীতে পতিত হইলেন। যীশুর আগমনের দিবস ও দণ্ড নির্দ্দেশক ঈশ্বরের বাণী বহুজলের কল্লোলের ন্যায় শীঘ্রই আমাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিল। মাত্র ১৪৪০০০ জন জীবিত ধার্ম্মিক ঐ বাণীর অর্থ বুঝিতে পারিয়াছিলেন, আর দুষ্টেরা উহাকে বজ্রধ্বনি ও ভূমিকম্প বলিয়া মনে করিল। সেই সময় নির্দ্দেশ করিবার কালে ঈশ্বর আমাদের উপরে পবিত্র আত্মা বর্ষণ করিলেন। তাহাতে সীনয় পর্ব্বত হইতে নামিয়া আসিলে, মোশিন মুখ যেমন উজজ্বল হইয়াছিল, সেইরূপ আমাদের মুখও ঈশ্বরের মহিমায় উজজ্বল হইল। CCh 65.1

১৪৪০০০ জন মুদ্রাঙ্কিত হইয়া সম্পূর্ণ একতাবদ্ধ হইলেন। তাঁহাদের ললাটে “ঈশ্বর, নূতন যিরুশালেম” এই কথাগুলি লিখিত ছিল, ও যীশুর নূতন নামযুক্ত একটী করিয়া উজজ্বল নক্ষত্র শোভা পাইতেছিল। আমাদের এই পবিত্র সুখে দুষ্টেরা ঈর্ষ্যান্বিত হইল, তাই তাহারা ক্রুদ্ধ হইয়া আমাদিগকে কারারুদ্ধ করিবার জন্য ধরিতে আসিলে আমরা ঈশ্বরের নামে হস্ত প্রসারিত করায়, তাহারা নিঃসহায় হইয়া ভূমিতে পতিত হইল। যাঁহারা পরস্পর পরস্পরের পদধৌত করেন ও পবিত্র চুম্বনে ভ্রাতৃবৃন্দকে আলিঙ্গন করিতে পারেন, তাঁহাদিগকেই ঈশ্বর ভালবাসেন- ইহা বুঝিতে পারিয়া শয়তানের অনুচরগণ আমাদের পদতলে পতিত হইয়া প্রণিপাত করিল। CCh 66.1

শীঘ্রই আমরা পূর্ব্বদিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, দেখিলাম, পূর্ব্বদিকে অর্দ্ধ হস্ত পরিমিত এক খণ্ড কৃষ্ণবর্ণ মেঘের উদয় হইয়াছে। আমরা সকলেই উহা মনুষ্যপুত্রের আগমনের চিহ্ন বলিয়া জানিতে পারিলাম। আমরা ব্যগ্রতার সহিত লক্ষ্য করিলাম, দেখিলাম যে, মেঘখণ্ড যতই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল, ততই উহা অধিকতর আলোকময় ও সমুজজ্বল হইতে থাকিল ও অবশেষে একখণ্ড বৃহৎ শুভ্র মেঘ বলিয়া প্রতীয়মান হইল। মেঘখণ্ডের নিম্নভাগ অগ্নির ন্যায় বোধ হইল, আর একটি মেঘধনু মেঘের উপরিভাগে অবস্থিত ছিল। উহার চতুষ্পার্শ্বে দশ সহস্র স্বর্গদূত, মধুর সঙ্গীতে রত ছিলেন; আর ঐ মেঘের উপরে মনুষ্যপুত্র উপবিষ্ট ছিলেন। তাহার শুভ্র কুঞ্চিত কেশগুলি স্কন্ধের উপরে আসিয়া পরিয়াছিল। ও মস্তকে অনেকগুলি মুকুট শোভা পাইতেছিল। তাহার পদদ্বয়ের আকৃতি দেখিতে অগ্নির ন্যায়, তাঁহারা দক্ষিণ হস্তে একখানি তীক্ষ্ণ কাস্ত্যা ও তাহার বাম হস্তে একটি রৌপ্য নির্ম্মিত তূরী ছিল। অগ্নিশিখাবৎ চক্ষু দ্বারা তিনি তাহার সন্তানগণের হৃদয় অনুসন্ধান করিলেন। তখন সকলেরই মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। যাহাদিগকে ঈশ্বর অগ্রাহ্য করিয়া পরিত্যাগ করিয়াছেলেন, তাঁহাদের মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল। আর আমারা সকলে বলিয়া উঠিলাম, “কে দাঁড়াইতে পারিবে? আমার চরত্র কি নিষ্কলঙ্ক?” তখন স্বর্গদূতেরা সঙ্গিত হইতে বিরধ হইলেন, তথাই কিছুক্ষনের জন্য ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিতে লাগিল। এমন সময় যীশু বলিলেন, “যাহাদের শুচি হস্ত ও বিশুদ্ধ অন্তকরণ আছে, তাহারা দাঁড়াইতে পারিবে। আমার অনুগ্রহ তোমাদের পক্ষে যথেষ্ট।” প্রভুর বাক্য শুনিয়া আমাদের সুখ উজজ্বল হইয়া উঠিল ও আনন্দে পরিপূর্ণ হইল। স্বর্গদূতেরা উচৈ্চঃস্বরে আর একটী সঙ্গিত আরম্ভ করিলেন, তখন সেই মেঘখণ্ড পৃথিবীর আরও নিকটবর্ত্তী হইল। CCh 67.1

যীশু অগ্নিশিখায় আবৃত হইয়া মেঘখণ্ডে অবতরণ করিতা করিতে তাঁহার রৌপ্য নির্ম্মত তূরীর ধ্বনি করিতে থাকিলেন। তখন তিনি নিদ্রিত সাধুদিগের কবরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তাঁহার চক্ষু ও হস্ত স্বর্গের দিকে উত্তোলন করতঃ উচ্চরবে ঘোষণা করিলেন, “জাগ্রত হও! জাগ্রত হও!! জাগ্রত হও!!! যাহারা ধূলায় নিদ্রা যাইতেছ, তাহারা উঠ।” তৎপরে এক ভীষণ ভূমিকম্প হওয়ায়, সাধুগণের কবর সকল খুলিয়া গেল, তাহাতে মৃত ধার্ম্মিকেরা অমরত্ব প্রাপ্ত হইয়া বাহির হইয়া আসিলেন। ১৪০০০ জন সাধু, তাঁহদের কোন কোন বন্ধু যাঁহারা মৃত্যুতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিলেন, তাহাদের চিনিতে পারিয়া “হাল্লিলূয়া” জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। আর ঠিক্ সেই সময়েই, আমরা রূপান্তরিত হইয়া তাহাদের সহিত আকত্রিত হইলাম ও আকাশে প্রভুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে মেঘযোগে নীত হইলাম। CCh 67.2

আমরা সকলে একত্রে মেঘ মধ্যে প্রবেশ করিয়া সাত দিনে কাঁচময় সমুদ্রের তীরে গিয়া পৌঁছিলাম। তথাই যীশু মুকুট আনিয়া স্বীয় দক্ষিণ হস্ত দ্বারা আমাদের মস্তকে স্থাপন করিলেন ও আমাদিগকে স্বর্ণ বীণা ও বিজয় পতাকা দান করিলেন। এই কাঁচময় সমুদ্রের উপরে ১৪০০০ জন চতুষ্পার্শ্বে সমভাবে দণ্ডারমান হইলেন। তাঁহাদের মধ্যে কাহারও কাহারও মস্তকের মুকুট অতীব উজজ্বল ছিল, আর কাহারও কাহারও মুকুট তত উজজ্বল ছিল না। কতকগুলি মুকুট বহু নক্ষত্র খচিত ছিল; কিন্তু কোন কোনটিতে নক্ষত্রের সংখ্যা অল্পই ছিল; নক্ষত্রের সংখ্যা কমি হউক অথবা বেশিই হউক, সকলেই স্ব স্ব মুকুট লাভে অত্যন্ত সন্তষ্ট হইয়াছিলেন। তাহারা সকলেই স্কন্ধ হইতে পদ পর্য্যন্ত দীর্ঘ্য উজজ্বল শুভ্র পরিচ্ছদে আবৃত ছিলেন। কাঁচময় সমুদ্রের উপর দিয়া নগরীর তরণদ্বার পর্য্যন্ত যাইবার কালে, দূতগণ আমাদের চতুর্দ্দিকে বর্ত্তমান ছিলেন। যীশু তাঁহার শক্তিশালী প্রতাপান্বিত বাহু দ্বারা সেই মুক্তা নির্ম্মিত দ্বারটী খুলিয়া দিয়া আমাদিগকে বলিলেন, “তোমরা আমার শোণিতে আপন আপন বস্ত্র ধৌত করিয়াছ এবং অবিচলিত ও অদম্য উৎসাহে আমার সত্য রক্ষা করিয়াছ, অতএব ভিতরে প্রবেশ কর।” তাহাতে আমরা সকলেই নগর মধ্যে প্রবেশ করিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, নগরে আমাদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। CCh 68.1

এখানে আমরা জীবনবৃক্ষ ও ঈশ্বরের সিংহাসন দেখিতে পাইলাম। আরও দেখিলাম সিংহাসন হইতে নির্ম্মল সলিলা একটী নদী বহির্গত হইয়াছে। ঐ নদীর উভয় তীরেই জীবন বৃক্ষ শোভা পাইতেছে, নদীর এক তীরে একটী কাণ্ড এবং অন্য তীরে অন্য আর একটী কাণ্ড, উভয়ই বিশুদ্ধ ও উজজ্বল স্বর্ণ নির্ম্মিত। প্রথমে আমি দুইটি বৃক্ষ দেখিতে পাইতেছি বলিয়া মনে করিলাম; কিন্তু পুনরায় দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিতে পাইলাম যে, দুইটী কাণ্ডই অগ্রভাগে গিয়া মিলিত হইয়া একটী বৃক্ষে পরিণত হইয়াছে; সুতরাং বুঝিতে পারিলাম যে, জীবন নদীর তীরেই জীবন বৃক্ষ পরিশোভিত। আমরা যে স্তানে দাঁড়াইয়াছিলাম, সেই স্থান প্রর্য্যন্ত ঐ জীবনবৃক্ষের সাখা আসিয়া ঝুকিয়া পড়িয়াছিল, সেই বৃক্ষের ফল অতি চমৎকার। ফলগুলি দেখিয়া ঠিক্ যেন রজত কাঞ্চনের একত্র সমাবেশ হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল। CCh 69.1

আমরা সকলে বৃক্ষের নিম্নে গিয়া সেই স্থানের মহিমা দর্শনার্থে উপবেশ করিলাম। তখন সুসমাছার প্রচারক ভ্রাতা ফিচ্ ও ভ্রাতা ষ্টক্ম্যান আমাদের নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তাহারা সমাধিতে নিদ্রিত থাকিবার কালে আমাদের উপরে কি কি ঘটনা ঘটিয়াছিল? তাহাতে আমরা আমাদের কঠোর পরীক্ষাগুলির বিষয় স্মরণ করিতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু আমরা যে অপারমনোরম মহিমা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাঁহার তুলনায় সে সকল পরীক্ষা এত সামান্য বলিয়া বোধ হইল যে, তাঁহাদের বিষয় বলিতে না পারিয়া আমরা উচৈচঃস্বরে বলিয়া উঠিলাম, “হাল্লিলূয়া, স্বর্গ অতি সুলভ!” — এই বলিয়া সুমধুর বাণীর ঝঙ্কারে স্বর্গ মুখরিত করিলাম। CCh 69.2

আমরা যীশুর অনুসরণ করিয়া তাঁহার সহিত সেই নগর হইতে এই পৃথিবীস্থ একটী বৃহৎ পর্ব্বতের উপরে অবতরণ করিলাম; কিন্তু পর্ব্বতটী প্রকাণ্ড হইলেও যীশুর ভারে দুইখণ্ড হইয়া গেল, তাহাতে তথায় এক সুবিস্তৃত ময়দান উৎপন্ন হইল। তৎপরে আমরা উর্দ্ধে দৃষ্টিপাত করিয়া সেই বৃহৎ নগর ও তাহার বারটী ভিত্তি, প্রতি পার্শ্বে তিনটি করিয়া বারটী দ্বার এবং প্রতি দ্বারে একজন করিয়া স্বর্গদূত দেখিতে পাইলাম। আমরা বলিয়া উঠিলাম, “নগর, মহানগর, স্বর্গের ঈশ্বরের নিকট হইতে নামিয়া আসিতেছে।” আমরা যে স্থানে দাঁড়াইয়াছিলাম, ঠিক্ সেই স্থানে আসিয়া নগরটি অবস্থিত হইল। তৎপরে আমরা নগরের নাহিরের মনোহর দৃশ্যসমূহ দেখিতে লাগিলাম। সেখানে আমরা অতীব সুন্দর সুন্দর গৃহ দেখিতে পাইলাম। গৃহগুলি দেখিতে রজতের ন্যায়, অত্যুজজ্বল মুক্তা খচিত, চারিটী স্তম্ভের উপরে প্রত্যেক গৃহ অবস্থিত ছিল।সেই সকল গৃহেই ধার্ম্মিকেরা বাস করিবেন। প্রত্যেক গৃহে একটী করিয়া স্বর্ণ নির্ম্মিত তাক ছিল। আমি দেখিলাম, ধার্ম্মিকদিগের অনেকে গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া, স্ব স্ব মস্তক হইতে উজজ্বল মুকুট লইয়া তাকের উপর রাখিয়া দিয়া, পুনরায় কার্য্য করিবার জন্য আপন আপন গৃহের নিকটবর্ত্তি ক্ষেত্রে বহির্গত হইলেন। আমরা এখানে ক্ষেত্রে যেরূপ কার্য্য করি উহা সেরূপ নহে, সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকারের। তাঁহাদের মস্তকের চারিদিকে উজজ্বল আলোকে শোভা পাইতেছিল; আর তাহারা অবিরত উচৈচঃস্বরে ঈশ্বরের মহিমা ও প্রশংসা কীর্ত্তন করিতেছিলেন। CCh 69.3

পরে আমি নানবিধ পুষ্পশোভিত অপর একটি ক্ষেত্র দেখিতে পাইলাম। সে সুন্দর পুষ্পগুলি চয়ন করিবার কালে আমি উচৈচঃস্বরে বলিয়া উঠিলাম, “এই পুষ্পগুলি কখনও মলিন হইবে না।” পরে দীর্ঘ তৃণাবৃত, দেখিতে অতীব সুন্দর একটী ময়দান আমার নয়ন পথে পতিত হইল। এই ময়দানটী সতেজ, সবুজ, আভা ধারণ করিয়াছিল। সেই সতেজ সবুজ তৃণগুলি রাজরাজেশ্বর যীশুর গৌরবে আন্দোলিত হইবার কালে রজত কাঞ্চনের প্রতিবিম্ব ধারন করিয়াছিল। তৎপরে আমরা আর একটী মাঠে উপস্থিথ হইলাম, সেখানে দেখিলাম, সিংহ, বৃক, চিতা, মেষশাবক প্রভৃতি সর্ব্বপ্রকার পশু মহাশান্তিতে একত্রে বাস করিতেছে। আমরা তাহাদের মধ্য দিয়া গমন করিবার কালে তাহারা ধীরে ধীরে আমাদের পশ্চাৎ অনুসরণ করিল। পরে আমরা একটি অরণ্য মধ্যে প্রবেশ করিলাম; কিন্তু সে বন এখনকার বনের ন্যায় অন্ধকারময় নহে। আলোক ভিন্ন, অন্ধকার সেখানে নাই। সমস্ত বনটীই উজজ্বলতাই পরিপূর্ণ। বৃক্ষের শাখাগুলি ইতস্ততঃ সঞ্চালিত হইতেছিল। আমরা সকলেই বলিয়া উঠিলাম, “আমরা প্রান্তরে নির্ভয়ে বাস করিব, ও বনে নিদ্রা যাইব।” আমরা বনের মধ্যে দিয়া ক্রমাগত সিয়োন পর্ব্বতের দিকে যাইতে থাকিলাম। CCh 70.1

ক্রমাগত চলিতে চলিতে, অপর একদল মনুষ্যের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইল; তাঁহারা আগ্রহ সহকারে স্থানটীর সৌন্দর্য্য দর্শন করিতছিলেন। আমি লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, তাঁহাদের পরিচ্ছদের প্রান্তগুলি রক্ত বর্ণ, মস্তকের মুকুট গুলি অত্যন্ত উজজ্বল ও পরিচ্ছদ তুষার ধবল। তাঁহাদিগকে সম্ভাষণ করিবার পর, আমি যীশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারা কে? তিনি বলিলেন, যাঁহারা তাঁহার জন্য প্রাণ বিসজর্জন করিয়াছিলেন, এই দল তাঁহাদেরই। তাঁহাদের সহিত অসংখ্য শিশুদেরও একটী দল ছিল। তাঁহাদের পরিচ্ছদের ধারও লাল বর্ণের ছিল। সিয়ন পর্ব্বতের ঠিক্‌ সম্মুখে আসিয়া আমরা উপস্থিত হইলাম। পর্ব্বতটির উপরে একটি পরম সুন্দর মন্দির দেখিতে পাইলাম। মন্দিরটীর চারিদিকে আরও সাতটী পর্ব্বত ছিল। তাঁহদের উপরে গোলাপ ও আর এক প্রকার সুন্দর শ্বেত পুষ্প শোভা পাইতেছিল। আমি দেখিলাম, শিশুগন পর্ব্বতে উঠিয়া গিয়া, অথবা ইচ্ছা হইলে পর্ব্বত শিখরে উড়িয়া গিয়া, সেই চির প্রস্ফুটিত পুষ্প গুলি চয়ন করিতেছে। সেই স্থানটিকে সুশোভিত করিবার জন্য মন্দিরের চতুষ্পার্শ্বে নানাবিধ বৃক্ষ ফলভরে অবনত থাকাই, সমস্ত স্থানটি সুন্দর শোভা ধারণ করিয়াছিল। আমরা পবিত্র মন্দিরে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইয়াছি, এমন সময়ে যীশু স্নেহ পূর্ণ স্বরে বলিলেন, “মাত্র ১৪৪০০০ জনের বিশষ দল এই স্থানে প্রবেশ করিতে পারে।” — এই কথা শুনিয়া আমরা “হাল্লিলূয়া” আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিলাম। CCh 71.1

এই মন্দিরটী ৭ টী স্তম্ভের উপরে অবস্থত ছিল। স্তম্ভগুলি সমস্তই অত্যুজজ্বল মণিমুক্তা খচিত ও স্বচ্ছ স্বর্ণ নির্ম্মিত। যে সকল অদ্ভুত দ্রব্যাদি সেখানে দর্শন করিয়াছিলাম, তাহা ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আহা! আমি যদি কনানের ভাষায় কথা বলিতে পারিতাম, তাহা হইলেই সেই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য্যের বিষয় কিঞ্চিৎ বলিতে পারিতাম। আমি দেখিলাম, প্রস্তর-ফলকের উপরে ১৪০০০ জনের নাম সুবর্ণাক্ষরে খদেত রহিয়াছে। মন্দিরের সৌন্দর্য্য দর্শন করিয়া আমরা বাহিরে চলিয়া গেলাম; যীশুও আমাদের সঙ্গ ছাড়িয়া নগরে গমন করিলেন। শীঘ্রই আমরা তাহার সুমধুর কণ্ঠস্বর সুনিতে পাইলাম। তিনি বলিলেন, “এস, বৎসগন, এস, তোমরা যথেষ্ট দুঃখ ভোগ করিয়াছ, তোমরা আদেশ পালন এবং আমার জন্য যথেষ্ট ক্লেশ ভোগ করিয়াছ, ভোজন করিতে আইস, আমি স্বযং তমাদিগকে পরিবেশন করিব” তাঁহার কথা শুনিয়া আমরা “হাল্লিলূয়া” আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিলাম। তৎপরে নগরে প্রবেশ করিয়া আমি একখানি বিশুদ্ধ রৌপ্য নির্ম্মিত মেজ দেখিতে পাইলাম। মেজ খানি দৈর্ঘ্যে বহু যোজন বিস্তৃত হইলেও উহার সমস্ত অংশই আমাদের দৃষ্টিগোচর হইল। সেই মেজের উপরে আমি জীবন বৃক্ষের ফল ও মান্না এবং বাদাম, আঙ্গুর, দাড়িম্ব প্রভৃতি নানা প্রকারের ফল দেখিতে পাইলাম। আমি সে সকল খাইবার জন্যে অনুমতি ভিক্ষা করিলাম, তাহাতে তিনি উত্তর করিলেন, “এখন নহে, কেননা যাহারা জীবন বৃক্ষের ফল খায়, তাহারা আর পৃথিবীতে ফিরিয়া যায় না। বিশ্বাসে স্থির থাকিলে অতি অল্প কাল পরেই তুমি জীবন বৃক্ষের ফল খাইতে ও উৎসের জল পান করিতে পাইবে।” তিনি বলিলেন “তুমি পুনরায় পৃথিবীতে গিয়া, আমি যাহা তোমার নিকটে প্রকাশ করিয়াছি, তাহা অপরাপর লোকের নিকটে বর্ণনা কর।” তৎপরে একজন স্বর্গীয় দূত ধীরে ধীরে আমাকে অন্ধকার পৃথিবীতে নামাইয়া দিলেন। সময় সময় আমার মনে হয়, আমি আর এখানে থাকিতে পারি না; কারণ এই পৃথিবীর সমস্তই আমার নিকট অতি নীরস বলিয়া মনে হয়। এই পৃথিবী অপেক্ষা উত্তম একটী দেশ আমি দেখিয়াছি বলিয়া, এই স্থানটি আমার নিকট অত্যন্ত নিজর্জন বলিয়া বোধ হয়। অহো! কপোতের ন্যায় আমার যদি পক্ষ থাকিত, তাহা হইলে আমি উড়িয়া গিয়া বিশ্রাম উপভোগ করিতাম!1 CCh 71.2