প্রেরিতগণের কার্য-বিবরণ
২২শ অধ্যায়—থিষলনীকী
ফিলিপি ত্যাগ করার পর পৌল এবং সীল থিষলনীকীতে গেলেন। সেখানে তাদেরকে যিহূদী সমাজগৃহে এক বৃহৎ জনসমাগমে বক্তব্য দানের সুযোগ দেওয়া হল। তাদের চেহারা ও পরিচ্ছদে স্পষ্ট বোঝা গেল যে, খুব সম্প্রতি তারা লাঞ্ছনা ও অবমাননার শিকার হয়েছেন এবং সে কারণেই তাদে কী ঘটেছে সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন ছিল। তবে এই সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তারা মোটেও নিজেদেরকে উচ্চীকৃত করলেন না, বরং যিনি তাঁদেরকে উদ্ধার করেছেন তাঁকেই কেবল গৌরব দান করলেন। AABen 183.1
থিষলনীকীয়দের কাছে প্রচার করতে গিয়ে পৌল পুরাতন নিয়মের মশীহের আগমন সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো উল্লেখ করলেন। খ্রীষ্ট তাঁর পরিচর্যা কালে তাঁর শিষ্যদের কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছিলেন; “মোশি হইতে ও সমুদয় ভাববাদী হইতে আরম্ভ করিয়া সমুদয় শাস্ত্রে তাঁহার নিজের বিষয়ে যে সকল কথা আছে, তাহা তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া দিলেন।” লুক ২৪:২৭। খ্রীষ্টকে প্রচার করতে গিয়ে পিতর পুরাতন নিয়ম থেকে সাক্ষ্য প্রমাণ দেখিয়েছেন। স্তিফানও একই উপায়ে প্রচার করেছিলেন। আর পৌলও তাঁর পরিচর্যা কাজে একইভাবে পবিত্র শাস্ত্র থেকে খ্রীষ্টের জন্ম, দুঃখভোগ, মৃত্যু, পুনরুত্থান ও স্বর্গারোহণ প্রচার করেছেন। মোশী ও অন্যান্য ভাববাদীর অনুপ্রাণিত সাক্ষ্য দ্বারা তিনি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে, নাসরতীয় যীশুই হলেন মশীহ্ এবং খ্রীষ্টের কণ্ঠস্বরই আদমের সময় থেকে শুরু করে আদিপিতাগণ ও ভাববাদীগণের মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে। AABen 183.2
প্রতিজ্ঞাত খ্রীষ্টের আগমন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সরল ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আদমকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল যে, একজন উদ্ধারকর্তার আগমন ঘটবে। শয়তানকে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল: “আমি তোমাতে ও নারীতে, এবং তোমার বংশে ও তাহার বংশে পরস্পর শত্রুতা জন্মাইব; সে তোমার মস্তক চূর্ণ করিবে, এবং তুমি তাহার পাদমূল চূর্ণ করিবে।” আদিপুস্তক ৩:১৫। এটিই ছিল আমাদের প্রথম পিতা মাতার কাছে খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে পরিত্রাণ লাভের প্রতিজ্ঞা। AABen 183.3
অব্রাহামের কাছে এই প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল যে, তাঁর বংশেই এই জগতের ত্রাণকর্তার আগমন ঘটবে: “আর তোমার বংশে পৃথিবীর সকল জাতি আশীর্বাদ প্রাপ্ত হইবে।” “তিনি বহুবচনে ‘আর বংশ সকলের প্রতি’ না বলিয়া, একবচনে বলেন, ‘‘আর তোমার বংশের প্রতি”; সেই বংশ খ্রীষ্ট।” আদিপুস্তক ২২:১৮; গালাতীয় ৩:১৬। AABen 184.1
ইস্রায়েল জাতির একজন নেতা এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের শেষ পর্যায়ে এসে মোশী পরিষ্কারভাবে আসন্ন মশীহের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। “তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু,” তিনি সমগ্র ইস্রায়েল জাতির কাছে ঘোষণা করেছেন, “তোমার মধ্য হইতে, তোমার ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে, তোমার জন্য আমার সদৃশ এক ভাববাদী উৎপন্ন করিবেন, তাঁহারই কথায় তোমরা কর্ণপাত করিবে।” সেই সাথে মোশী ইস্রায়েলীয়দেরকে এই নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর স্বয়ং হোরেব পর্বতে তাঁর কাছে এই সত্য ব্যক্ত করেছেন। “আমি উহাদের জন্য উহাদের ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে তোমার সদৃশ এক ভাববাদী উৎপন্ন করিব, ও তাঁহার মুখে আমার বাক্য দিব; আর আমি তাঁহাকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিব, তাহা তিনি উহাদিগকে বলিবেন।” দ্বি.বি. ১৮:১৫, ১৮। AABen 184.2
মশীহের আগমন হওয়ার কথা ছিল রাজকীয় এক বংশে, কারণ যাকোবের কাছে ঈশ্বর যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, “যিহূদা হইতে রাজদণ্ড যাইবে না, তাহার চরণযুগলের মধ্য হইতে বিচারদণ্ড যাইবে না, যে পর্যন্ত শীলো না আইসেন; জাতিগণ তাঁহারই অধীনতা স্বীকার করিবে।” আদিপুস্তক ৪৯:১০। AABen 184.3
শিাইয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: “আর যিশয়ের গুঁড়ি হইতে এক পল্লব নির্গত হইবেন, ও তাহার মূল হইতে উৎপন্নএক চারা ফল প্রদান করিবেন।” “কর্ণপাত কর, আমার নিকটে আইস; শ্রবণ কর, তোমাদের প্রাণ সঞ্জীবিত হইবে; আর আমি তোমাদের সহিত এক নিত্যস্থায়ী নিয়ম করিব, দায়ূদের [প্রতি কৃত] অটল দয়া স্থির করিব। দেখ, আমি তাঁহাকে জাতিগণের সাক্ষীরূপে, জাতিগণের নায়ক ও আদেষ্টারূপে নিযুক্ত করিলাম। দেখ, তুমি যে জাতিকে জান না, তাহাকে আহ্বান করিবে; যে জাতি তোমাকে জানিত না, সে তোমার কাছে দৌড়াইয়া আসিবে; ইহা তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভুর নিমিত্ত, ইস্রায়েলের পবিত্রতমের হেতু ঘটিবে, কেননা তিনি তোমাকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন।” যিশাইয় ১১:১; ৫৫:৩—৫। AABen 184.4
যিরমিয়ও দাউদের গৃহের রাজপুত্র হিসেবে ত্রাণকর্তার আগমনের সাক্ষ্য দিয়েছেন: “সদাপ্রভু কহেন, দেখ, এমন সময় আসিতেছে, যে সময়ে আমি দায়ূদের বংশে এক ধার্মিক পল্লব উৎপন্নকরিব; তিনি রাজা হইয়া রাজত্ব করিবেন, বুদ্ধিপূর্বক চলিবেন, এবং দেশে ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতার অনুষ্ঠান করিবেন। তাঁহার সময়ে যিহূদা পরিত্রাণ পাইবে, ও ইস্রায়েল নির্ভয়ে বাস করিবে, আর তিনি এই নামে আখ্যাত হইবেন, ‘‘সদাপ্রভু আমাদের ধার্মিকতা।” তিনি আরও বলেছেন: ” কেননা সদাপ্রভু এই কথা কহেন, ইস্রায়েল—কুলের সিংহাসনে উপবিষ্ট হইতে দায়ূদের বংশীয় পুরুষের অভাব হইবে না; আর নিত্য আমার সম্মুখে হোম উৎসর্গ, ভক্ষ্য—নৈবেদ্য দাহ ও বলিদান করিতে লেবীয় যাজকদের স¤পর্কীয় লোকের অভাব হইবে না।”যিরমিয় ২৩:৫, ৬; ৩৩:১৭, ১৮। AABen 185.1
এমনকি মশীহের জন্মস্থান সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল: “আর তুমি, হে বৈৎলেহম—ইফ্রাথা, তুমি যিহূদার সহস্রগণের মধ্যে ক্ষুদ্রা বলিয়া অগণিতা, তোমা হইতে ইস্রায়েলের মধ্যে কর্তা হইবার জন্য আমার উদ্দেশে এক ব্যক্তি উৎপন্ন হইবেন; প্রাক্কাল হইতে, অনাদিকাল হইতে তাঁহার উৎপত্তি।” মীখা ৫:২। AABen 185.2
জগতে ত্রাণকর্তা যে কাজ সাধন করতে চলেছেন সে ব্যাপারে স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়েছে: “আর সদাপ্রভুর আত্মা—প্রজ্ঞার ও বিবেচনার আত্মা, মন্ত্রণার ও পরাক্রমের আত্মা, জ্ঞানের ও সদাপ্রভু—ভয়ের আত্মা— তাঁহাতে অধিষ্ঠান করিবেন; আর তিনি সদাপ্রভু—ভয়ে আমোদিত হইবেন। তিনি চক্ষুর দৃষ্টি অনুসারে বিচার করিবেন না, কর্ণের শ্রবণানুসারে নিষ্পত্তি করিবেন না।”এভাবেই সেই অভিষিক্ত জন নিজের সম্পর্কে বলেছেন, “নম্রগণের কাছে সুসমাচার প্রচার করিতে সদাপ্রভু আমাকে অভিষেক করিয়াছেন; তিনি আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, যেন আমি ভগ্নান্তঃকরণ লোকদের ক্ষত বাঁধিয়া দিই; যেন বন্দি লোকদের কাছে মুক্তি, ও কারাবদ্ধ লোকদের কাছে কারামোচন প্রচার করি; যেন সদাপ্রভুর প্রসন্নতার বৎসর ও আমাদের ঈশ্বরের প্রতিশোধের দিন ঘোষণা করি; যেন সমস্ত শোকার্তকে সান্ত্বনা করি; যেন সিয়োনের শোকার্ত লোকদিগকে বর দিই, যেন তাহাদিগকে ভস্মের পরিবর্তে শিরোভূষণ, শোকের পরিবর্তে আনন্দতৈল, অবসন্ন আত্মার পরিবর্তে প্রশংসারূপ পরিচ্ছদ দান করি; তাই তাহারা ধার্মিকতা—বৃক্ষ ও সদাপ্রভুর রোপিত তাঁহার ভূষণার্থক উদ্যান বলিয়া আখ্যাত হইবে।” যিশাইয় ১১:২, ৩; ৬১:১—৩। AABen 185.3
“ঐ দেখ, আমার দাস, আমি তাঁহাকে ধারণ করি; তিনি আমার মনোনীত, আমার প্রাণ তাঁহাতে প্রীত; আমি তাঁহার উপরে আপন আত্মাকে স্থাপন করিলাম; তিনি জাতিগণের কাছে ন্যায় বিচার উপস্থিত করিবেন। তিনি চিৎকার করিবেন না, উচ্চশব্দ করিবেন না, পথে আপন রব শুনাইবেন না। তিনি থেৎলা নল ভাঙ্গিবেন না; সধূম শলিতা নির্বাপিত করিবেন না; সত্যে তিনি ন্যায়বিচার প্রচলিত করিবেন। তিনি নিস্তেজ হইবেন না, নিরুৎসাহ হইবেন না, যে পর্যন্ত না পৃথিবীতে ন্যায়বিচার স্থাপন করেন; আর উপক‚লসমূহ তাঁহার ব্যবস্থার অপেক্ষায় থাকিবে।” যিশাইয় ৪২:১—৪। AABen 186.1
মন পরিবর্তনকারী ক্ষমতা নিয়ে পৌল পুরাতন নিয়মের শাস্ত্র থেকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “খ্রীষ্টের মৃত্যুভোগ ও মৃতগণের মধ্য হইতে পুনরুত্থান করা আবশ্যক ছিল।” মীখা কি ভবিষ্যদ্বাণী করেননি যে, “লোকে দণ্ড দিয়া ইস্রায়েলের বিচারকর্তার হনূতে আঘাত করিবে”? মীখা ৫:১। এমনকি ভাববাদী যিশাইয়ের মধ্য দিয়ে স্বয়ং প্রতিজ্ঞাত জন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, “আমি প্রহারকদের প্রতি আপন পৃষ্ঠ, যাহারা দাড়ি উপড়াইয়াছে, তাহাদের প্রতি আপন গাল পাতিয়া দিলাম, অপমান ও থুথু হইতে আপন মুখ আচ্ছাদন করিলাম না।” যিশাইয় ৫০:৬। গীতসংহিতা রচয়িতার লেখনীতে খ্রীষ্ট মানুষের কাছ থেকে যে কষ্টভোগ করবেন তারই ভবিষ্যদ্বাণী লিখেছেন: “কিন্তু আমি . . AABen 186.2
. মনুষ্যদের নিন্দাস্পদ, লোকদের অবজ্ঞাত। যাহারা আমাকে দেখে, সকলে আমাকে ঠাট্টা করে, তাহারা ওষ্ঠ বাহির করিয়া মাথা নাড়িয়া বলে, সদাপ্রভুর উপরে নির্ভর কর; তিনি উহাকে উদ্ধার করুন; উহাকে রক্ষা করুন, কেননা তিনি উহাতে প্রীত।” “আমি আপন অস্থি সকল গণনা করিতে পারি; উহারা আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে, চাহিয়া থাকে। তাহারা আপনাদের মধ্যে আমার বস্ত্র বিভাগ করে, আমার পরিচ্ছদের জন্য গুলিবাঁট করে।” “আমি হইয়াছি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে বিদেশী, আমার সহোদরগণের কাছে বিজাতীয়। কারণ তোমার গৃহনিমিত্তক উদ্যোগ আমাকে গ্রাস করিয়াছে; যাহারা তোমাকে তিরস্কার করে, তাহাদের তিরস্কার আমার উপরে পড়িয়াছে।” “তিরস্কারে আমার মনোভঙ্গ হইয়াছে, আমি অবসন্ন হইলাম, আমি সহানুভূতির অপেক্ষা করিলাম, কিন্তু তাহা নাই; সান্ত্বনাকারীদের অপেক্ষা করিলাম, কিন্তু কাহাকেও পাইলাম না।” গীতসংহিতা ২২:৬—৮, ১৭, ১৮; ৬৯:৮, ৯, ২০। AABen 186.3
খ্রীষ্টের কষ্টভোগ ও মৃত্যু সম্পর্কে যিশাইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী কতটা না অব্যর্থ তথাপি সরল! “আমরা যাহা শুনিয়াছি, তাহা কে বিশ্বাস করিয়াছে?” ভাববাদী জানতে চাইছেন, “সদাপ্রভুর বাহু কাহার কাছে প্রকাশিত হইয়াছে? কারণ তিনি তাঁহার সম্মুখে চারার ন্যায়, এবং শুষ্ক ভূমিতে উৎপন্ন মূল্যের ন্যায় উঠিলেন; তাঁহার এমন রূপ কি শোভা নাই যে, তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করি, এবং এমন আকৃতি নাই যে, তাঁহাকে ভালবাসি। তিনি অবজ্ঞাত ও মনুষ্যদের ত্যাজ্য, ব্যথার পাত্র ও যাতনা পরিচিত হইলেন; লোকে যাহা হইতে মুখ আচ্ছাদন করে, তাহার ন্যায় তিনি অবজ্ঞাত হইলেন, আর আমরা তাঁহাকে মান্য করি নাই। AABen 187.1
“সত্য, আমাদের যাতনা সকল তিনিই তুলিয়া লইয়াছেন, আমাদের ব্যথা সকল তিনি বহন করিয়াছেন; তবু আমরা মনে করিলাম, তিনি আহত, ঈশ্বরকর্তৃক প্রহারিত ও দুঃখার্ত। কিন্তু তিনি আমাদের অধর্মের নিমিত্ত বিদ্ধ, আমাদের অপরাধের নিমিত্ত চূর্ণ হইলেন; আমাদের শান্তিজনক শাস্তি তাঁহার উপরে বর্তিল, এবং তাঁহার ক্ষত সকল দ্বারা আমাদের আরোগ্য হইল। AABen 187.2
“আমরা সকলে মেষগণের ন্যায় ভ্রান্ত হইয়াছি, প্রত্যেকে আপন আপন পথের দিকে ফিরিয়াছি; আর সদাপ্রভু আমাদের সকলের অপরাধ তাঁহার উপরে বর্তাইয়াছেন। তিনি উপদ্রুত হইলেন, তবু দুঃখভোগ স্বীকার করিলেন, তিনি মুখ খুলিলেন না; মেষশাবক যেমন হত হইবার জন্য নীত হয়, মেষী যেমন লোমচ্ছেদকদের সম্মুখে নীরব হয়, সেইরূপ তিনি মুখ খুলিলেন না। তিনি উপদ্রব ও বিচার দ্বারা অপনীত হইলেন; তৎকালীয়দের মধ্যে কে ইহা আলোচনা করিল যে, তিনি জীবিতদের দেশ হইতে উচ্ছিন্ন হইলেন? আমার জাতির অধর্ম প্রযুক্তই তাঁহার উপরে আঘাত পড়িল।” যিশাইয় ৫৩:১—৮। AABen 187.3
এমনকি তিনি কীভাবে মৃত্যুবরণ করবেন সেটাও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। যেভাবে পিতলের সাপটিকে প্রান্তরে উঁচুতে তুলে ধরা হয়েছিল সেভাবে ত্রাণকর্তাকেও উঁচুতে তুলে ধরা হবে, “যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।” যোহন ৩:১৬। AABen 187.4
“আর যখন কেহ তাহাকে বলিবে, তোমার দুই হস্তের মধ্যে এই সকল ক্ষতের দাগ কি? তখন সে উত্তর করিবে, আমার আত্মীয়দের বাটীতে যে সকল আঘাত পাইয়াছি, এ সেই সকল আঘাত।” সখরিয় ১৩:৬। AABen 188.1
“আর লোকে দুষ্টগণের সহিত তাঁহার কবর, নিরূপণ করিল, এবং মৃত্যুতে তিনি ধনবানের সঙ্গী হইলেন, যদিও তিনি দৌরাত্ম্য করেন নাই, আর তাঁহার মুখে ছল ছিল না। তথাপি তাঁহাকে চূর্ণ করিতে সদাপ্রভুরই মনোরথ ছিল; তিনি তাঁহাকে যাতনাগ্রস্ত করিলেন।” যিশাইয় ৫৩:৯, ১০। AABen 188.2
কিন্তু যাঁর দুষ্টদের হাতে যাতনা পাওয়ার কথা ছিল তিনি পাপ ও কবরের উপরে বিজয়ী হিসেবে উত্থিত হলেন। সর্বশক্তিমানের অনুপ্রেরণায় ইস্রায়েলের সুকণ্ঠ গায়ক পুনরুত্থানের প্রভাতের মহিমার সাক্ষ্য দান করেছেন। “এই জন্য আমার চিত্ত আনন্দিত, ও আমার গৌরব উল্লসিত হইল; আমার মাংসও নির্ভয়ে বাস করিবে। কারণ তুমি আমার প্রাণ পাতালে পরিত্যাগ করিবে না, তুমি নিজ সাধুকে ক্ষয় দেখিতে দিবে না।” গীতসংহিতা ১৬:৯, ১০। AABen 188.3
পৌল দেখিয়েছেন ঈশ্বর কতটা নিবিড়ভাবে উৎসর্গের আনুষ্ঠানিকতাকে সেই প্রতিজ্ঞাত জনের সাথে যুক্ত করেছেন, যাঁকে মেষের মত হত হওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। মশীহ্ তাঁর নিজ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন “পাপ উৎসর্গ” হিসেবে। ত্রাণকর্তার এই উৎসর্গের ঘটনা ঘটার আরও কয়েক শতাব্দী আগেই ভাববাদী যিশাইয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ঈশ্বরের মেষশাবক “মৃত্যুর জন্য আপন প্রাণ ঢালিয়া দিলেন, তিনি অধর্মীদের সহিত গণিত হইলেন; আর তিনিই অনেকের পাপভার তুলিয়া লইয়াছেন, এবং অধর্মীদের জন্য অনুরোধ করিতেছেন।” যিশাইয় ৫৩:৭, ১০, ১২। AABen 188.4
ভবিষ্যদ্বাণীকৃত ত্রাণকর্তার আগমনের তখনও বাকি ছিল, তবে যিহূদী জাতিকে পার্থিব অত্যাচারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাগতিক অধিপতি হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হয়ে মানুষের মধ্যে দারিদ্র ও নম্রতায় জীবন যাপনের জন্য, এবং সবশেষে অবজ্ঞাত, প্রত্যাখ্যাত ও হত হওয়ার জন্য। পুরাতন নিয়মের শাস্ত্রে ত্রাণকর্তা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, তিনি নিজেকে এক অধঃপতিত জাতির জন্য বলি হিসেবে উৎসর্গ করবেন, আর এভাবেই ভগ্ন বিধানের প্রত্যেকটি শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে। তাঁর মধ্য দিয়েই উৎসর্গের সমস্ত প্রতিরূপ তার মূল রূপের দেখা পেল এবং তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যু সমগ্র যিহূদী সমাজে এক আমূল পরিবর্তন সাধন করল। AABen 188.5
পৌল থিষলনীকীর বিশ্বাসীদেরকে বলেছিলেন পূর্বে শাস্ত্রের আচার অনুষ্ঠান ও বিধি বিধানের জন্য তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল এবং এরপর তিনি দামেস্কের দ্বারে সেই অভ‚তপূর্ব প্রত্যাদেশের অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। মন পরিবর্তনের পূর্বে তিনি তিনি তাঁর ধার্মিকতা নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, যা ছিল আসলে ভ্রান্ত বিশ্বাস। তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি খ্রীষ্টেতে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তিনি কেবলমাত্র বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান ও বিধি পালনে বিশ্বাস করতেন। আইন কানুনের প্রতি তাঁর ভক্তির কারণে তিনি খ্রীষ্টের প্রতি বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত ছিলেন। তিনি যে আইন কানুন পালনে সম্পূর্ণ নির্দোষ তা নিয়ে যখন তিনি গর্ব করতেন সে সময় তিনি তাঁকেই আসলে অবজ্ঞা ও প্রত্যাখ্যান করছিলেন, যার মধ্য দিয়ে সমস্ত আইন কানুন পরিপূর্ণতা পায়। AABen 189.1
কিন্তু তাঁর মন পরিবর্তনের সাথে সাথে সব কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেল। যে নাসরতীয় যীশুর পবিত্র লোকদের অত্যাচার করার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিলেন, তিনি নিজেই প্রতিজ্ঞাত মশীহ্ হিসেবে তাঁর সামনে উপনীত হলেন। তখন অত্যাচারী পৌল তাঁকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে অবলোকন করলেন, যিনি সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করার জন্য জগতে নেমে এসেছেন এবং যিনি তাঁর এই জীবনে পবিত্র শাস্ত্রের প্রত্যেকটি বাক্যকে পূর্ণতা দিয়েছেন। পবিত্রতায় পূর্ণ সাহসিকতা নিয়ে পৌল থিষলনীকীর যিহূদী সমাজগৃহে সুসমাচার প্রচার করলেন, তখন আবাস তাঁবুর সাথে সম্পৃক্ত সমস্ত আচার অনুষ্ঠান ও নিয়ম কানুনের প্রকৃত অর্থের উপরে আলোকপাত করা হল। তিনি তাঁর শ্রোতাদেরকে খ্রীষ্টের জাগতিক পরিচর্যা কাজের পেছনে তাঁর যে ঐশ্বরিক দায়িত্ব পালনের ছিল তা ব্যাখ্যা করে বললেন। তিনি আরও বললেন যে, যখন সময় হবে তখন খ্রীষ্ট তাঁর মধ্যস্থতামূলক কাজ সম্পন্ন করারর জন্য পূর্ণ মহিমায় ও ক্ষমতায় ফিরে আসবেন এবং জগতে তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। পৌল খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আগমনে বিশ্বাসী ছিলেন; কাজেই তিনি স্পষ্টভাবে সেই ঘটনা সম্পর্কিত সত্যকে উপস্থাপন করলেন, যেন যারা তা শুনবে তাদের উপরে এমন এক প্রভাব সৃষ্টি হয় যা আর কখনো মুছে না যায়। AABen 189.2
পর পর তিনটি শাব্বাথে পৌল থিষলনীকীয়দের কাছে প্রচার করলেন এবং তাদেরকে শাস্ত্র অনুসারে খ্রীষ্টের জীবন, মৃত্যু, পুনরুত্থান, পরিচর্যা কাজ ও ভবিষ্যৎ মহিমার কথা ব্যাখ্যা করলেন। “এই মেষ—শিশুকে জগৎ সৃষ্টির আগেই মেরে ফেলবার জন্য ঠিক করা হয়েছিল।” প্রকাশিত বাক্য ১৩:৮ (Common Language Version)। তিনি খ্রীষ্টকে উচ্চীকৃত করেছিলেন, যাঁর পরিচর্যা কাজ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধিই আমাদের সামনে পুরাতন নিয়মের শাস্ত্রকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করে এবং তার অগাধ ধনভাণ্ডারে নিমজ্জিত হতে সুযোগ দেয়। AABen 189.3
থিষলনীকীয়দের কাছে এভাবে সুসমাচারের সত্য পরাক্রমের সাথে প্রচারিত হওয়ার পর তা বিরাট সংখ্যক জনতাকে আকৃষ্ট করল। “এই কথা শুনে কয়েকজন যিহূদী বিশ্বাস করে পৌল ও সীলের সংগে যোগ দিল। এছাড়া ঈশ্বরভক্ত অনেক গ্রীক এবং অনেক বিশেষ বিশেষ মহিলাও তাঁদের সংগে যোগ দিলেন।” AABen 190.1
এর আগের মত এখানেই প্রেরিতগণ বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন। যে সকল যিহূদী বিশ্বাস করেনি তারা “হিংসা” করতে শুরু করল। এই যিহূদীরা তখন আর রোমীয়দের আনুক‚ল্যে ছিল না, কারণ মাত্র কিছুদিন আগেই তারা রোমেও একটি দাঙ্গা বাধিয়েছিল। তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা হত এবং তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা অনেকটাই খর্ব করা হয়েছিল। এখন তারা নিজেদের অধিকার ফেরত পাওয়ার একটা সুযোগ নেওয়ার চিন্তা করল এবং সেই সাথে প্রেরিতগণ ও খ্রীষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত বিশ্বাসীদের উপরে তাদের আক্রোশ চরিতার্থ করার কথা ভাবতে লাগল। AABen 190.2
এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা “বাজার থেকে কিছু দুষ্ট লোক যোগাড় করে এনে ভিড় জমাল” এবং তাদেরকে প্ররোচনা দিয়ে তারা “শহরের মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে দিল।” প্রেরিতগণকে খুঁজে পাওয়ার আশায় তারা “যাসোনের বাড়ীর উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল;” কিন্তু তারা পৌল বা সীল কাউকেই খুঁজে পেল না। আর যখন “সেখানে তারা তাঁদের পেল না,” তখন ক্ষুব্ধ জনতা নিরাশ হয়ে আরও বেশি উন্মত্ত হয়ে উঠল এবং “যাসোন ও কয়েকজন বিশ্বাসী ভাইকে টেনে নিয়ে শহর—প্রশাসকদের কাছে গেল এবং চিৎকার করে বলল, যে লোকেরা সারা দুনিয়া তোলপাড় করে তুলেছে তারা এখন এখানেও উপস্থিত হয়েছে; আর যাসোন তার নিজের বাড়ীতে ওদের জায়গা দিয়েছে। ওরা সবাই সম্রাট কৈসরের আদেশ অমান্য করে বলছে যে, তিনি ছাড়া যীশু নামে আরও একজন রাজা আছেন।” AABen 190.3
পৌল ও সীলকে খুঁজে না পাওয়ায় শাসনকর্তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযুক্ত বিশ্বাসীদেরকে সাময়িকভাবে বন্দী রাখলেন। আরও বেশি সহিংসতার আশঙ্কা করে “বিশ্বাসী ভাইয়েরা পৌল ও সীলকে বিরয়াতে পাঠিয়ে দিল।” AABen 191.1
আজ যারা সত্যকে প্রচার করতে গিয়ে মানুষের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন, তারা যদি খ্রীষ্ট বিশ্বাসীদের কাছেও যথাযথ সাড়া না পান পান, এমনকি পৌল ও তাঁর সহকর্মীরা যতটা অবজ্ঞাত হয়েছেন তার চেয়েও বেশি অবজ্ঞাত তাদের হতে হয়, তাতেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। ক্রুশের বার্তাবাহকদের অবশ্যই নিজেদেরকে জাগ্রত রেখে ও প্রার্থনায় রত থেকে বিশ্বাস ও সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে হবে এবং সব সময় যীশুর নামে কাজ করে যেতে হবে। তাদের অবশ্যই যীশুকে স্বর্গে আমাদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গৌরবান্বিত করতে হবে, যাঁকে কেন্দ্র করে পুরাতন নিয়মের সমস্ত উৎসর্গ ও আচার অনুষ্ঠান আবর্তিত হয়েছে এবং যাঁর মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের বিধান লক্সঘনকারীরা শান্তি ও ক্ষমা লাভের সুযোগ পেয়েছে। AABen 191.2