প্রেরিতগণের কার্য-বিবরণ
১৮শ অধ্যায়—পরজাতীয়দের মধ্যে সুসমাচার প্রচার
পিষিদিয়ার আন্তিয়খিয়া থেকে পৌল ও বার্ণবা ইকনিয়ে গেলেন। এখানেও তাঁরা আন্তিয়খিয়ার মত যিহূদীদের মাঝে তাদের সমাজ—গৃহে পরিচর্যা কাজ করতে শুরু করলেন। সেখানেও তাঁরা প্রচুর সাফল্য লাভ করলেন; “যিহূদী ও গ্রীকদের বিস্তর লোক বিশ্বাস করিল।” কিন্তু অন্যান্য স্থানের মত ইকনিয়েও যখন প্রেরিতরা পরিচর্যা করেছেন তখন “যে যিহূদীরা অবাধ্য হইল, তাহারা ভ্রাতৃগণের বিপক্ষে পরজাতীয়দের মনকে উত্তেজিত করিল ও বিষাইয়া তুলিল।” AABen 144.1
তবে প্রেরিতদ্বয় তাঁদের কাজ থেকে সরে আসেননি, কারণ অনেকেই সেখানে খ্রীষ্টের সুসমাচার গ্রহণ করেছিল। শত প্রতিবন্ধকতা, ঈর্ষা ও গোঁড়ামি উপেক্ষা করে তাঁরা তাঁদের কাজ করে গেছেন। তাঁরা “প্রভুর উপরে সাহস বাঁধিয়া কথা কহিতেন” এবং ঈশ্বরও “আপন অনুগ্রহের বাক্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিতেন, তাঁহাদের হস্ত দ্বারা নানা চিহ্ন—কার্য ও অদ্ভুত লক্ষণ সাধিত হইতে দিতেন।” যানা নিজেদের অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল তাদের মনে ঐশ্বরিক কর্তৃত্বের এই সমস্ত সাক্ষ্য এক পরাক্রমী প্রভাব ফেলেছিল এবং সুসমাচারের বিশ্বাসীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। AABen 144.2
প্রেরিতদের প্রচার করা বার্তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারণে অবিশ্বাসী যিহূদীরা দারুনভাবে অন্তর্জ্বালায় ও ঘৃণায় পুড়তে লাগল এবং তারা যে কোন মূল্যে অবিলম্বে পৌল ও বার্ণবাকে থামানো সিদ্ধান্ত নিল। মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তুলে তারা নগরের শাসনকর্তার মনে এই ভয় জাগিয়ে তুলল যে, পুরো নগরী বিপ্লবী হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা বলল যে, প্রচুর লোক প্রতিনিয়ত প্রেরিতদের সাথে গিয়ে যুক্ত হচ্ছে এবং তারা নিশ্চয়ই গোপনে কোন বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র করছে। AABen 144.3
______________________________________«
এই অধ্যায়টি প্রেরিত ১৪:১—২৬ পদের উপর ভিত্তি করে রচিত AABen 144.4
______________________________________«
এই সব অভিযোগের কারণে শিষ্যদেরকে বারবার শাসনকর্তার সামনে বিচারের জন্য আনা হল; কিন্তু তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও বোধগম্য, উপরন্তু তারা যে শিক্ষা দিচ্ছিলেন তাও ছিল অত্যন্ত প্রশান্ত এবং সুবোধ্য, যা শাসনকর্তাদের মধ্যেও এক ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছিল। যদিও বিচারকদের মধ্যে অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে বলা মিথ্যা অভিযোগগুলো শুনে বেশ পক্ষপাতপূর্ণ হয়ে পড়েছিলেন, তথাপি তাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার সাহস তাদের হল না। তরা এ কথা স্বীকার না করে পারলেন না যে, পৌল ও বার্ণবার শিক্ষার কারণে মানুষ আরও সৎ, আইন পরায়ণ নাগরিক ও নৈতিক মানুষ হয়ে উঠেছে এবং প্রেরিতরা যে সত্যের শিক্ষা দিচ্ছিলেন তা গ্রহণ করে নিলে এই নগরীর আরও উনড়বতি হবে। AABen 145.1
শিষ্যরা যে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তাতে করে সত্যের বার্তা দারুনভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করল; যিহূদীরা দেখল তারা এই নব্য ধর্মগুরুদের কাজ রুদ্ধ করতে গিয়ে বরং উল্টো হয়েছে। এখন প্রতিদিনই আরও বেশি করে মানুষ এই নতুন বিশ্বাসকে গ্রহণ করছে। “নগরের লোকসমূহ দুই দলে বিভক্ত হইল, এক দল দিহূদীদের পক্ষ, অন্য দল প্রেরিতদের পক্ষ হইল।” AABen 145.2
পরিস্থিতির পট পরিবর্তনে যিহূদী নেতারা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল যে, তারা সহিংস উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের সিদ্ধান্ত নিল। অশিক্ষিত ও কলহপ্রিয় জনতাকে খেপিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে তারা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হল, যার দায় তারা পুরোপুরি শিষ্যদের দেওয়া শিক্ষার উপরে চাপিয়ে দিল। এই মিথ্যা অভিযোগের মধ্য দিয়ে তারা বিচারকদের মধ্য দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে চাইল। তারা ঠিক করেছিল প্রেরিতদেরকে তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগই দেবে না এবং বিক্ষুব্ধ জনতা কোন বিচারের সুযোগ না দিয়েই পৌল ও বার্ণবাকে পাথর মেরে তাদের এই অভিসন্ধি সফল করবে। AABen 145.3
প্রেরিতরা বন্ধুরা পরজাতীয় হলেও তাদেরকে যিহূদীদের এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন এবং তাদেরকে অযথা উন্মত্ত জনতার কাছে না গিয়ে বরং এখান থেকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। পৌল ও বার্ণবা তাদের কথা শুনে গোপনে ইকনিয় থেকে চলে গেলেন এবং বিশ্বাসীদেরকে কিছু দিনের জন্য পরিচর্যা কাজ এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। কিন্তু তারা মোটেও সেখান থেকে চিরকালের মত বিদায় নেননি; এই টালমাটাল অবস্থা কিছুটা শান্ত হলেই তারা আবার ফিরে এসে তাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন বলে প্রত্যয় করলেন। AABen 145.4
সকল যুগে ও সকল ভ‚খন্ডে ঈশ্বরের বার্তাবাহকরা তাদের কাছ থেকেই সবচেয়ে তিক্ত আচরণ ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন যারা স্বেচ্ছায় স্বর্গীয় জ্যোতি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কখনো কখনো মিথ্যা অভিযোগ ও ভুল ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সুসমাচারের বিরোধীরা আপাতদৃষ্টিতে জয়ী হয়েছে এবং এতে করে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য ঈশ্বরের বার্তাবাহকদের দরজা রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এই দরজা সব সময় রুদ্ধ থাকবে না এবং কখনো কখনো ঈশ্বরের সেবকগণ যখন কিছু দিন পর আবারও তাঁদের কাজে ফিরে এসেছেন তখন প্রভু তাদের পক্ষে পরাক্রমের সাথে কাজ করেছেন এবং তাঁর নামের মহিমা প্রকাশের জন্য তাদেরকে বিশেষভাবে পরাক্রমী করে তুলেছেন। AABen 146.1
ইকনিয় থেকে নির্যাতিত হয়ে বেরিয়ে আসার পর প্রেরিতদ্বয় লুকায়নিয়ার লুস্ত্রা ও দর্বী নগরে গেলেন। এই নগরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে কুসংস্কারাচ্ছনড়ব পরজাতীয় মানুষ বসবাস করত, কিন্তু তাদের মধ্যেও এমন অনেকে ছিল যারা সুসমাচারের বার্তা শ্রবণ করতে ও গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল। এই স্থানগুলোতে এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রেরিতদ্বয় পরিচর্যা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আশা করলেন হয়তো এখানে তাঁদেরকে যিহূদীদের গোঁড়ামি ও তাড়নার মুখে পড়তে হবে না। AABen 146.2
লুস্ত্রা নগরে কোন যিহূদী সমাজ—গৃহ ছিল না, যদিও কয়েকজন যিহূদী সেই নগরে বাস করত। লুস্ত্রার অধিবাসীদের অনেকেই জুপিটার বা দ্যুপিতর দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত একটি মন্দিরে গিয়ে উপাসনা করত। পৌল ও বার্ণবা যখন সেই নগরে গেলেন এবং তাদের চারপাশে লুস্ত্রার অধিবাসীরা জড়ো হল তখন তাঁরা তাদের কাছে সুসমাচারের সরল সত্য প্রচার করলেন এবং তখন অনেকেই জুপিটার দেবতার উপাসনায় যে সমস্ত পৌত্তলিক ধ্যান ধারণা পোষণ করত সেগুলোর আদলে এই শিক্ষাকে মিলিয়ে দেখতে শুরু করল। AABen 146.3
প্রেরিতদ্বয় এই পৌত্তলিক মানুষগুলোকে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর ও তাঁর পুত্র, এই জগতের ত্রাণকর্তার সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁরা প্রথমে ঈশ্বরের অপূর্ব সমস্ত সৃষ্টির প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন — সূর্য, চাঁদ, তারা, ঋতুর অপূর্ব পরিবর্তন, বিশাল গাছ, তুষারে ছাওয়া সুউচ্চ পর্বত এবং প্রকৃতির আরও অনেক বিস্ময়কর উপাদান, যা মানবীয় বোধগম্যতার বহিভর্‚ত এক জ্ঞানের কথা প্রকাশ করে। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার এই কাজের কথা বন্দনা করার মাধ্যমে প্রেরিতদ্বয় পরজাতীয়দেরকে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের মহান ও সর্বশক্তিমান শাসনকর্তার ধারণাটি দিতে চাইলেন। AABen 146.4
সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে এই সকল মৌলিক সত্য সরলভাবে ব্যক্ত করার পর প্রেরিতগণ লুস্ত্রার অধিবাসীদেরকে ঈশ্বরের পুত্রের কথা বললেন, যিনি স্বর্গ থেকে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন কারণ তিনি মানব সন্তানদেরকে ভালবাসেন। তাঁর জীবন ও পরিচর্যা কাজ, যাদেরকে তিনি রক্ষা করতে এসেছিলেন তাদের দ্বারা তাঁর প্রত্যাখ্যাত হওয়া, তাঁর বিচার ও ক্রুশারোপণ, তাঁর পুনরুত্থান, এবং তাঁর স্বর্গারোহণ, সেখানে মানুষের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন এই সমস্ত কথা তাঁরা তাদেরকে বললেন। এভাবে ঈশ্বরের আত্মায় ও ক্ষমতায় পূর্ণ হয়ে পৌল ও বার্ণবা লুস্ত্রায় সুসমাচার প্রচার করতে লাগলেন। AABen 147.1
একবার পৌল যখন লোকদের কাছে বলছিলেন যে, কীভাবে খ্রীষ্টঅসুস্থ ও পীড়িত মানুষকে সুস্থ করেছেন, তখন তিনি শ্রোতাদের মধ্যে একজন পক্ষাঘাতগ্রস্থ মানুষকে দেখলেন যার দৃষ্টি পৌলের দিকে নিবদ্ধ ছিল এবং সে তাঁর কথাগুলো শুনে তা গ্রহণ করেছিল। এই পীড়িত মানুষটিকে দেখে পৌলের অন্তর সমবেদনায় পূর্ণ হল এবং তাকে দেখে তিনি বুঝলেন “সুস্থ হইবার জন্য তাহার বিশ্বাস আছে।” সেই পৌত্তলিক শ্রোতামন্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে পৌল পক্ষাঘাতগ্রস্থ লোকটিকে আদেশ দিলেন যেন সে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এর আগ পর্যন্ত লোকটি কেবল উঠে বসতে পারত, কিন্তু এখন পৌলের আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে পালন করে লোকটি জীবনে প্রথমবারের মত তার পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সে শক্তি ফিরে পেয়েছিল এবং যে এক সময় পঙ্গু ছিল সে “লম্ফ দিয়া উঠিল ও হাঁটিতে লাগিল।” AABen 147.2
“পৌল যাহা করিলেন, তাহা দেখিয়া লোকেরা লুকায়নীয় ভাষায় উচ্চ রবে বলিতে লাগিল, দেবতারা মনুষ্য—রূপ ধারণ করিয়া আমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হইয়াছেন।” তারা এই কথা খুব সহজেই বলে ফেলেছিল, কারণ তাদের ধারণা অনুসারে দেবতাদের কখনো সখনো পৃথিবী পরিদর্শনের নিদর্শন রয়েছে। বার্ণবার সৌম্য ও সম্ভ্রান্ত চেহারা এবং নম্র ও স্নেহশীল আচরণের জন্য তারা তাঁকে দেবতাদের পিতা দ্যুপিতর বা জুপিটার বলে আখ্যা দিল। পৌলকে তারা মর্কুরিয় বা হার্মিস বলে আখ্যা দিল, কারণ তিনি ছিলেন “প্রধান বক্তা,” একাগ্র ও সক্রিয়, এবং বিভিন্ন সতর্কবাণী ও উৎসাহমূলক বক্তব্যের কারণে বাক্যবাগীশ বলে আখ্যাত। AABen 147.3
লুস্ত্রার লোকেরা তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য জুপিটার দেবতার মন্দিরের যাজককে বলল যেন তিনি প্রেরিতদেরকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেন এবং সেই যাজক “কতকগুলি বৃষ ও মালা দ্বারদেশে আনিয়া লোকদের সহিত বলিদান করিতে চাহিল।” পৌল এবং বার্ণবা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং তারা যে এই সব প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটা তাঁরা জানতেন না। কাজেই বাইরের গান বাজনা ও বিরাট জনতার হইচই শুনে তারা যে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। AABen 148.1
প্রেরিতদ্বয় যখন তাদের এই আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারলেন তখন তাঁরা “আপন আপন বস্ত্র ছিঁড়িয়া, দৌড়াইয়া বাহির হইয়া লোকদের মধ্যে” গেলেন যেন তারা আর অগ্রসর না হয়। এত লোকের হইচই ছাপিয়ে পৌল আরও জোরে চিৎকার করে লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন; এতে যখন জনতার হইহট্টগোল শেষ হল তখন তিনি বললেন: “মহাশয়েরা, এই সকল কেন করিতেছেন? আমরাও আপনাদের ন্যায় সুখদুঃখভোগী মনুষ্য; আমরা আপনাদিগকে এই সুসমাচার জানাইতেছি যে, এই সকল অসার বস্তু হইতে সেই জীবন্ত ঈশ্বরের প্রতি ফিরিয়া আসিতে হইবে, যিনি আকাশ, পৃথিবী, সমুদ্র এবং সেই সকলের মধ্যবর্তী সমস্তই নির্মাণ করিয়াছেন। তিনি অতীত পুরুষপর¤পরায় সমস্ত জাতিকে আপন আপন পথে গমন করিতে দিয়াছেন; তথাপি তিনি আপনাকে সাক্ষ্যবিহীন রাখেন নাই, কেননা তিনি মঙ্গল করিতেছেন, আকাশ হইতে আপনাদিগকে বৃষ্টি এবং ফলোৎপাদক ঋতুগণ দিয়া ভক্ষ্যে ও আনন্দে আপনাদের হৃদয় পরিতৃপ্ত করিয়া আসিতেছেন।” AABen 148.2
প্রেরিতদ্বয় যে আসলে স্বর্গের দেবতা সে কথা নম্রভাবে অস্বীকার করা এবং লোকদের মনকে এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের দিকে ফেরানোর জন্য পৌলের শত চেষ্টা সত্ত্বেও পরজাতীয় এই লোকদেরকে বলি উৎসর্গ করা থেকে বিরত রাখা খুবই কঠিন কাজ ছিল। তাঁরা যে দেবতা এই বিশ্বাস তাদের মনে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল এবং তাদের উৎসাহ এত বেশি প্রবল ছিল যে, তারা তাদের ভুলটা বুঝতেই চাইছিল না। বলা হয়েছে “তাঁহারা কষ্টে সৃষ্টে তাঁহাদের উদ্দেশে বলিদান করণ হইতে লোকসমূহকে নিবৃত্ত করিলেন।” AABen 148.3
লুস্ত্রার লোকেরা নিজেদেরকে এই যুক্তি দেখিয়েছিল যে, তারা নিজেদের চোখে প্রেরিতদের অলৌকিক কাজ করতে দেখেছে। যে পক্ষাঘাতগ্রস্থ লোকটি জন্ম থেকে হাঁটতে পারত না তাকে তারা পূর্ণ শক্তিতে ও সুস্বাস্থ্যে হেঁঁটে বেড়াতে দেখেছে। পৌল তাদেরকে হাজারভাবে বোঝানোর পর এবং তিনি ও বার্ণবা যে স্বর্গের ঈশ্বর ও তাঁর পুত্র মহান সুস্থতাদানকারী খ্রীষ্টের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের মধ্যে এসেছেন তা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার পর লোকেরা তাদের সমস্ত আয়োজন বন্ধ করার জন্য সম্মত হল। AABen 149.1
“আন্তিয়খিয়া ও ইকনিয় হইতে কয়েক জন যিহূদী” আসার কারণে লুস্ত্রায় পৌল ও বার্ণবার পরিচর্যা কাজ বাধাপ্রাপ্ত হল। এই যিহূদীরা শুনেছিল যে, লুস্ত্রায় প্রেরিতদ্বয় দারুন সাফল্য লাভ করেছেন, আর তাই তারা তাঁদেরকে তাড়না করার জন্য লুস্ত্রায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। লুস্ত্রায় আসার পর এই যিহূদীরা খুব দ্রুত লোকদের মধ্যে একইভাবে তিক্ততার আত্মা ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের মনগড়া কথা প্রতিষ্ঠা করতে সফল হল।মিথ্যা অপবাদ ও নিন্দার কারণে যারা এর আগে পৌল ও বার্ণবাকে স্বর্গের দেবতা হিসেবে আখ্যা দিচ্ছিল তারাই এখন প্রেরিতদেরকে হত্যাকারীর চেয়েও জঘণ্য অপরাধী এবং মৃত্যুদন্ডের যোগ্য বলে সাব্যস্ত করতে লাগল। AABen 149.2
প্রেরিতদের উদ্দেশে বলি উৎসর্গের উদ্যোগ নিয়ে তাতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় লুস্ত্রাবাসীরা যতটা হতাশ হয়েছিল, তার জন্য এখন তারা পৌল ও বার্ণবার বিরুদ্ধে আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বিরোধিতা শুরু করল। যিহূদীদের উসকানিতে তারা প্রেরিতদের উপরে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিল। যিহূদীরা তাদেরকে নির্দেশ দিল যেন তারা পৌলকে একটুও কথা বলতে না দেয়, কারণ তারা ভেবেছিল যদি তারা তাঁকে একটুও কথা বলার সুযোগ দেয় তাহলে তিনি লোকদের এই ভ্রান্ত চিন্তা থেকে সরিয়ে নিতে পারবেন। AABen 149.3
সুসমাচারের শত্রুরা খুব দ্রুত তাদের এই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা মাঠে নামাল। শয়তানের ইন্ধন পেয়ে লুস্ত্রার লোকেরা এক অশুভ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠল এবং পৌলকে ধরে নির্দয়ভাবে পাথর মারল। প্রেরিত পৌল ভেবেছিলেন এবার বুঝি তাঁর জীবনের অবসান ঘটল। স্তিফানকে হত্যা করার যে নির্দয় ঘটনাটিতে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, সেই ঘটনার দৃশ্যগুলো তাঁর মনে পড়তে লাগল। আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে এবং ব্যথায় জর্জরিত হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে থাকলেন, আর উন্মত্ত জনতা তাঁকে “নগরের বাহিরে টানিয়া লইয়া গেল, মনে করিল, তিনি মরিয়া গিয়াছেন।” AABen 149.4
পৌল ও বার্ণবার পরিচর্যায় যারা মন পরিবর্তন করে যীশুর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল সেই লুস্ত্রা নগরীর বিশ্বাসীরা এই অন্ধকার সময়েও বিশ্বস্ত ছিল। শত্রুদের অন্যায্য মিথ্যা অভিযোগ ও নিষ্ঠুর তাড়নার ফলে এই নিবেদিতপ্রাণ ভাইদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিল; আর এখন শত বিপদ ও পীড়নের মুখোমুখি হয়েও তারা সেই প্রেরিতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন, যাকে তারা মৃত বলে ভেবেছিলেন। AABen 150.1
প্রচন্ড শোকাকুল অবস্থাতে তারা তীব্র বিস্ময়ে অভিভ‚ত হলেন যখন প্রেরিত পৌল হঠাৎ করে মাথা উঠিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালেন এবং নিজ মুখে ঈশ্বরের প্রশংসা ও গৌরব করতে লাগলেন। বিশ্বাসীদের কাছে ঈশ্বরের পরিচর্যাকারীর এই আকস্মিক জীবন লাভ এক ঐশ্বরিক অলৌকিক কাজ এবং তাদের নতুন ধর্ম গ্রহণের প্রতি ঈশ্বরের স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য হল। তারা সকলে তখন অবর্ণনীয় আনন্দে নতুন বিশ্বাসে ঈশ্বরের প্রশংসা করতে লাগলেন। AABen 150.2
তাদের মধ্যে যারা লুস্ত্রাতেই বিশ্বাসী হয়েছিলেন এবং পৌলের কষ্টভোগের সাক্ষী ছিলেন এমন একজন পরবর্তীতে খ্রীষ্টের পক্ষে কার্যকর সেবক হয়েছিলেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি প্রেরিতদের সাথে বিচারে দাঁড়িয়েছেন এবং বিভিন্ন স্থানে অগ্রগামী হিসেবেও গিয়েছেন। এই তরুণ বিশ্বাসীটি ছিলেন তীমথি। পৌলকে যখন শহরের বাইরে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসা হয় তখন এই যুবকটি সেই সব লোকদের সাথে ছিলেন যারা পৌলের প্রাণহীন দেহের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা তাঁকে প্রাণ ফিরে পেয়ে রক্তাক্ত উঠে বসতে দেখেছেন এবং পরক্ষণেই তাঁকে মুখ খুলে প্রভুর বন্দনা করতে দেখেছেন, কারণ তিনি খ্রীষ্টের পক্ষে নির্যাতন ভোগের জন্য নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন। AABen 150.3
পৌলকে পাথর মারার পরদিন প্রেরিতরা দর্বীর উদ্দেশে যাত্রা করলেন, যেখানে তাঁদের পরিচর্যা কাজ আশীর্বাদ পেয়েছিল এবং বহু আত্মা খ্রীষ্টকে তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু “সেই নগরে সুসমাচার প্রচার করিয়া এবং অনেক লোককে শিষ্য করিয়া” পৌল ও বার্ণবা এর আগে যাদের মনকে পরিবর্তন করেছেন তাদের বিশ্বাসকে আবারও পুনরুজ্জীবিত না করে সামনে এগোনোর কথা ভাবলেন না। কাজেই বিপদের আশঙ্কা না করে “তাঁহারা লুস্ত্রায়, ইকনিয়ে ও আন্তিয়খিয়ায় ফিরিয়া গেলেন; যাইতে যাইতে তাঁহারা শিষ্যদের মন সুস্থির করিলেন, এবং তাঁহাদিগকে আশ্বাস দিতে লাগিলেন, যেন তাহারা বিশ্বাসে স্থির থাকে।” অনেকেই সুসমাচারের বাক্যে সাড়া দিয়ে মন পরিবর্তন করেছিল এবং এভাবে তারা নিজেদেরকে ভর্ৎসনা ও তাড়নার শিকারে পরিণত করেছিল। এদেরকেই প্রেরিতদ্বয় আবারও বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবিত করে তোলার জন্য ফিরে গিয়েছিলেন। AABen 150.4
নতুন বিশ্বাসীদের আত্মিক বৃদ্ধি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রেরিতরা সব সময় তাদেরকে সুসমাচারের বাক্যের আলোকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখার পথ জানাতেন। লাইকনিয়া ও পিষিদিয়ার যেখানে বিশ্বাসীরা ছিলেন সেখানে মন্ডলী স্থাপন করা হয়েছিল। প্রত্যেকটি মন্ডলীতে কর্মকর্তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল এবং বিশ্বাসীদের সমস্ত আত্মিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য যথাযথ নিয়ম কানুন ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। AABen 151.1
খ্রীষ্টের সমস্ত বিশ্বাসীকে এক দেহে যুক্ত করার যে সুসমাচারীয় পরিকল্পনা, তার সাথে এই কার্যক্রম দারুনভাবে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। যেখানেই লোকেরা তাঁর পরিচর্যার কারণে খ্রীষ্টকে ত্রাণকর্তা হিসেবে গ্রহণ করেছে সেখানেই তিনি যথা সময়ে একটি মন্ডলী প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনকি বিশ্বাসীরা সংখ্যায় গুটিকয়েক হলেও তিনি একই প্রক্রিয়ায় মন্ডলী স্থাপন করেছেন। এভাবেই খ্রীষ্টিয়ানদের এই প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে একে অন্যকে সাহায্য করার জন্য শেখানো হয়েছিল, “যেখানে দুই কি তিন জন আমার নামে একত্র হয়, সেখানে আমি তাহাদের মধ্যে আছি।” মথি ১৮:২০। AABen 151.2
যে মন্ডলীগুলো এভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেগুলোকে পৌল ভুলে যাননি। এই মন্ডলীগুলোর যত্ন নেওয়ার ভার তাঁর মনে চিরকালের মত গেঁথে গিয়েছিল। মন্ডলী যত ছোটই হোক না কেন তিনি কখনোই তা অবহেলা করেননি। তিনি ছোট মন্ডলীকেও খুব যত্ন সহকারে পরিচর্যা করতেন, কারণ তিনি জানতেন এই মন্ডলীগুলোর সদস্যদেরকে সত্যে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং তাদের চারপাশের সমস্ত মানুষের কাছে স্বার্থহীন ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুসমাচারের বাণী নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন আছে। AABen 151.3
পৌল ও বার্ণবা তাদের সকল মিশনারী অভিযানে খ্রীষ্টের স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের দৃষ্টান্ত করে আত্মা জয়ের জন্য বিশ্বস্ত ও আন্তরিক পরিচর্যাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চোখ কান খোলা রেখে, তীব্র উদ্দীপনা নিয়ে এবং অক্লান্তভাবে কাজ করার সময় তারা কখনোই নিজেদের আরাম আয়েশের কথা ভাবেননি, বরং প্রার্থনাশীল উদ্বেগের মধ্য দিয়ে ও বিরতিহীন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তাঁরা সত্যের বীজ বপন করে গেছেন। আর এই বীজ বপনের সাথে যারা সুসমাচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাদেরকে প্রেরিতগণ অত্যন্ত বাস্তবধর্মী মূল্যবান কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। একাগ্রতা ও ঈশ্বরভীতির আত্মা এই নতুন শিষ্যদের মনে সুসমাচারের এই বার্তার গুরুত্ব সম্পর্কে এক চিরস্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করে দিয়েছিল। AABen 152.1
প্রত্যয়ী ও সমর্থ মানুষেরা যখন মন পরিবর্তন করেন, যেমনটা ঘটেছিল তীমথির ক্ষেত্রে, তখন পৌল ও বার্ণবা দ্রাক্ষাক্ষেত্রে তাদের শ্রম দানের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছেন। আর যখন এই প্রেরিতদ্বয় অন্য একটি স্থানে গেছেন তখন এই সব মানুষের বিশ্বাসে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি, বরং তা আরও বেড়েছে। তাদেরকে বিশ্বস্ততার সাথে ঈশ্বরের পথ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং শেখানো হয়েছে কীভাবে স্বার্থহীন, একাগ্র ও অধ্যবসায়ী হয়ে মানুষের পরিত্রাণের জন্য পরিশ্রম করতে হয়। নতুন বিশ্বাসীদেরকে এই সমস্ত শিক্ষা সতর্কতার সাথে প্রদান করা ছিল পরজাতীয়দের দেশগুলোতে পৌল ও বার্ণবার অভ‚তপূর্ব সাফল্যের অন্যতম একটি বড় দিক। AABen 152.2
প্রথম পরিচর্যার যাত্রা শেষ দিকে চলে আসছিল। নতুন গঠিত মন্ডলীগুলোকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করে প্রেরিতদ্বয় পাম্ফ‚লিয়াতে চলে যান, ” আর তাঁহারা পর্গাতে বাক্য প্রচার করিয়া অত্তালিয়াতে চলিয়া গেলেন।” AABen 152.3