প্রেরিতগণের কার্য-বিবরণ

51/59

৫০ অধ্যায়—মৃত্যুদন্ড

নীরোর সামনে পৌলের শেষ বিচারের সময় প্রেরিতের জোরালো বক্তব্যের ফলে সম্রাটের মনে এমন দৃঢ়ভাবে ছাপ ফেলেছিল যে, মামলার সিদ্ধান্ত ভিনড়ব রকম ভাবে প্রদান করলেন, ঈশ্বরের দাসকে অভিযোগ থেকে অব্যহতি ও দিলেন না আবার অভিযোগের জন্য দোষী সাব্যস্তও করলেন না। কিন্তু পৌলের বিরুদ্ধে সম্রাটের বিদ্বেষ খুব দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসল। খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার এমনকি তার রাজকীয় পরিজনের মধ্যে ও এর প্রসার দমন করার তার অক্ষমতার ফলে ধৈর্যহারা হয়ে তিনি স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন যে যথশীঘ্র সম্ভব আপাতত গ্রহনযোগ্য অজুহাত খুঁজে পেতে হবে যাতে পৌলকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যায়। এরপর খুব বেশিদিন অতিবাহিত না হতেই নীরো পৌলকে সাক্ষ্যমরের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার ঘোষনা দিলেন। যেহেতু রোমীয় নাগরীকগন নিপীরনের অধিনে নয় তাই, তাকে শিরোচ্ছেদ করার দন্ডাদেশ দেওয়া হল। AABen 428.1

পৌলকে গোপনভাবে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার স্থানে নিয়ে যাওয়া হল। খুব অল্পসংখ্যক দর্শক থাকার অনুমতি লাভ করেছিল; তার ভয় ছিল যে তার মৃত্যুর দৃশ্য দেখে নব দীক্ষিতরা খ্রীষ্ট ধর্মকে বিজয়ী করতে পারে। কিন্তু কঠিন হৃদয়ের সৈন্যরা যারা তার সাথে ছিল তারা তার কথা শুনেছিল এবং প্রচন্ড বিষ্ময়ে তার উৎফুল্লতাকে দেখতে পেল এবং মৃত্যু অবসম্ভরী জেনেও তাকে আনন্দিত অবস্থায় দেখতে পেল। যারা তার সাক্ষ্যমরের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তারা তার হত্যাকারীদের প্রতি তার ক্ষমার মনোভাব এবং খ্রীষ্টের প্রতি তার অবিচল বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত স্থির ছিল, পৌল যাদের কাছে প্রচার করেছিলেন তাদের মধ্যে একাধিক খ্রীষ্টকে গ্রহন করেছিলেন এবং তাদের রক্তের সঙ্গে তাদের বিশ্বাস নির্ভিকভাবে মুদ্রিত করেছিলেন। AABen 428.2

পৌল করিন্থিয়দের কাছে যে সত্যের বাক্য লিখেছিলেন তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার প্রমান রেখেছিলেন, “কারণ যে ঈশ্বর বলিয়াছিলেন, “অন্ধকারের মধ্য হইতে দীপ্ত প্রকাশিত হইবে,” তিনিই আমাদের হৃদয়ে দীপ্তি প্রকাশিত করিলেন, যেন যীশু খ্রীষ্টের মুখমন্ডলে ঈশ্বরের গৌরবের জ্ঞান দীপ্তি প্রকাশিত পায়। কিন্তু এই ধন মৃন্ময় পাত্রে করিয়া আমরা ধারণ করিতেছি, যেন পরাক্রমের উৎকর্ষ ঈশ্বরের হয়, আমাদের হইতে নয়। আমরা সর্ব প্রকারে ক্লিষ্ট হইতেছি, কিন্তু সংকটাপনড়ব হই না; হতবুদ্ধি হইতেছি; কিন্তু নিরাশ হই না, তাড়িত হইতেছি, কিন্তু পরিত্যাক্ত হই না; অধঃক্ষিপ্ত হইতেছি, কিন্তু বিনষ্ট হই না। আমরা সর্বদা এই দেহে যীশুর মৃত্যু বহন করিয়া বেড়াইতেছি, যেন যীশুর জীবন ও আমাদের দেহে প্রকাশ পায়। তার পর্যাপ্ততা তার নিজের ছিল না। কিন্তু পবিত্র আত্মার উপস্থিতি ও তার মাধ্যম যা তার জীবন পূর্ণ করেছেন এবং খ্রীষ্টের ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে তার সমস্ত চিন্তার মধ্যে স্থান দিয়েছেন। ভাববাদী উল্লেখ করেছেন, “যাহার মন তোমাতে সুস্থির তুমি তাহাকে শান্তিতেই রাখিবে, কেননা তোমাতেই তাহার নির্ভর।” যিশাইয় ২৬:৩। যে স্বর্গীয় শান্তি পৌলের মুখ মন্ডলে প্রকাশিত হয়েছিল তার মাধ্যমে অনেক আত্মাকে সুসমাচারের জন্য জয় করা গিয়েছিল। AABen 428.3

পৌল তার সঙ্গে স্বর্গের পরিবেশকে বহন করেছিলেন। যারা তার সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা সকলে খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রভাব উপলব্ধি করেছিলেন। বাস্তবতা হল, তিনি যে সত্য ঘোষনা করেছিলেন তা তার জীবনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিল, তার প্রচারে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদক শক্তি প্রদান করেছিল। একটি পবিত্র জীবনের স্বাভাবিক, অচেতন প্রভাব হল দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদক ধর্মপ্রদেশ যা খ্রীষ্ট ধর্মের পক্ষে দেওয়া যেতে পারে। এমনকি কেবল অকাট্য যুক্তি বিরোধীদের ক্রুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু একজন ধার্মিকের এমন ক্ষমতা আছে যা প্রতিরোধ করা একেবারেই অসম্ভব। AABen 429.1

প্রেরিত সেই সমস্ত লোকদের জন্য তার নিজের কষ্টভোগের কথা ভুলে গিয়েছিলেন যারা তাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। কিছু কিছু খ্রীষ্টিয়ান যারা তার কাজে সাহায্যকারী হিসেবে সঙ্গে ছিলেন তারা ধার্মিকতার জন্য অত্যাচিারিত হওয়ার জন্য যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল তার পূনরাবৃত্তি করার দ্বারা তাকে শক্তিশালী ও সাহস যুগিয়েছিলেন। তিনি তাদের এই নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে প্রভু তার অনুগত এবং বিশ্বস্ত সন্তানদের সম্পর্কে যে সব কথা বলেছেন তার একটিও ব্যর্থ হবে না। কিন্তু কালের জন্য বিভিনড়ব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হবে, তাদের জাগতিক আরাম আয়েশের অভাব ঘটবে; কিন্তু তারা তাদের হৃদয় ঈশ্বরের বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তার উক্তি দ্বারা সঞ্জিবীত করবে, “কেননা যাহাকে বিশ্বাস করিয়াছি তাহাকে জানি এবং দৃঢ়রূপে প্রত্যয় করিতেছি যে, আমি তাহার কাছে যাহা গচ্ছিত রাখিয়াছি, তিনি সেই দিনের জন্য তাহা রক্ষা করিতে সামর্থ।” ২য় তীমথিয় ১:১২। খুব শীঘ্র কষ্টভোগ এবং পরীক্ষার রাত্রির অবসান ঘটবে এবং এরপর শান্তি এবং প্রকৃত দিনের আনন্দময় সকালের শুরু হবে। AABen 429.2

প্রেরিতের দৃষ্টি ছিল বহুদূর বিস্তৃত, অনিশ্চয়তা কিংবা ভয়ের সঙ্গে নয়, কিন্তু আনন্দপূর্ণ আশা এবং একান্ত প্রত্যাশার সঙ্গে যখন তিনি সাক্ষ্যমরের স্থানে দাড়িয়ে ছিলেন তখন তার দৃষ্টি জল্লাতের তরবারির দিকে ছিল না অথবা সেই মাটির দিকে যে মাটি খুব শীঘ্র তার রক্ত গ্রহন করতে যাচ্ছে। তিনি গ্রীস্মকালের সেই শান্ত নীল আকাশের মধ্য দিয়ে অবিনস্বর সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। AABen 430.1

এই বিশ্বাসের মানুষটি যাকোবের সিড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলেন যা খ্রীষ্টকে উপস্থাপন করে, যিনি পৃথিবী ও স্বর্গের সঙ্গে এবং সসীম মানুষের সঙ্গে অসীম ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি তার পূর্বপূরুষ এবং ভাববাদীর কথা স্বরণ করে এমন একজনের উপর তিনি সমস্ত ভার অর্পন করেছিলেন যিনি তার সাহায্যকারী এবং সান্তনাকারী এবং যার জন্য তিনি তার জীবন দিচ্ছেন। এই সকল পবিত্র লোকেরা যারা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে তাদের বিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করেছেন তাদের কাছ থেকে তিনি এই নিশ্চয়তার বাণী শুনেছেন যে ঈশ্বর সত্য। তার সহ প্রেরিত, যিনি খ্রীষ্টের সুসমাচার প্রচার করতে গিয়ে ধর্মীয় গোড়ামী, পরজাতীয়দের কুসংস্কার, নির্যাতন এবং নিন্দার সম্মুখিন হয়েছিলেন, যারা তাদের জীবনকে নিজেদের কাছে প্রিয় বলে গন্য করে নি যে তারা খ্রীষ্টধর্মের প্রতি অবিশ্বাসের মধ্যে ক্রুশের আলো তুলে বহন করতে পারবে — এই সব লোকদের কাছে তিনি জগতের মুক্তিদাতা, ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে যীশুর সাক্ষ্য তুলে ধরেছিলেন। জগতের যন্ত্রনাকর অবস্থা থেকে বিপদের মধ্য থেকে, মাটির নিচে অন্ধকার কারাগারে, কূপ এবং গুহা থেকে তিনি সাক্ষ্যমরদের বিজয়োল্লাসের চিৎকার কানে শুনতে পেলেন। তিনি অবিচল আত্মার সাক্ষ্য শুনলেন, যারা যদিও সহায় সম্বলহীন, যাতনাগ্রস্থ, অত্যাচারিত, তবুও বিশ্বাসের জন্য নির্ভিকভাবে পবিত্র সাক্ষ্য বহন করেছিলেন, তারা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, “কেননা যাহাকে বিশ্বাস করিয়াছি তাহাকে জানি।” তারা তাদের বিশ্বাসের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, জগতের কাছে ঘোষনা করার জন্য যে, যাদের তিনি বিশ্বাস করে দায়িত্বভার অর্পন করেছেন তারা শেষপর্যন্ত তা রক্ষা করতে সামর্থ। AABen 430.2

খ্রীষ্টের জীবন উৎসর্গের দ্বারা মুক্ত হয়ে, তার রক্তে ধৌত হয়ে এবং তার ধার্মিকতার বস্ত্র পরিধান করে পৌল নিজের সম্পর্কে এই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তার মুক্তিদাতার দৃষ্টিতে তার জীবন মহামূল্যবান। খ্রীষ্টের সঙ্গে ঈশ্বরের মধ্যে তার জীবন লুকায়িত আছে এবং এই প্রত্যয় লাভ করেছিলেন যে, যিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন তিনি তার যে দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন তা রক্ষা করতে সমর্থ। তার মন মুক্তিদাতার প্রতিজ্ঞাকে আঁকড়ে ধরেছিল, “আর আমিই তাহাকে শেষ দিনে উঠাইব। যোহন ৬:৪০। তার প্রভুর দ্বিতীয় আগমনের উপর তার চিন্তা এবং প্রত্যাশা কেন্দ্রীভূত ছিল। আর জল্লাদের তরবারি যেভাবে নেমে এসেছিল এবং সাক্ষমরের মৃত্যুর ছায়াকে একত্রিত করেছিল তাতে তার সর্বশেষ চিন্তাকে দ্রুত সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলে, এভাবে তার মহা উত্থানের মধ্য দিয়ে প্রথমে তিনি জীবনদাতার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন, যিনি তাকে স্বর্গীয় সুখের আনন্দের মাঝে স্বাগত জানাবেন। AABen 431.1

ঈশ্বরের বাক্যের জন্য এবং যীশু খ্রীষ্টের সাক্ষ্য তুলে ধরার জন্য একজন সাক্ষ্যদানকারী হিসাবে বৃদ্ধ পৌল তার রক্তপাতের পর থেকে প্রায় একশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কোন বিশ্বস্ত হাত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই পবিত্র মানুষটির জীবনের শেষ ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেন নি, কিন্তু স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ আমাদের জন্য তার সাক্ষ্য সংরক্ষন করেছে। মহা শব্দকারী তূরীর মত তার কন্ঠ সকল যুগের মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে, তার নিজের সাহসের ফলে খ্রীষ্টের জন্য হাজার হাজার সাক্ষী সাহসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার নিজের বিজয়োল্লাসের আনন্দ প্রতিধ্বনীত হয়েছে, “কেননা আমি তখন পেয় নৈবদ্যের ন্যায় ঢালা যাইতেছি এবং আমার প্রস্থানের সময় উপস্থিত হইয়াছে। আমি উত্তম যুদ্ধে প্রানপন করিয়াছি, নিরুপিত সময়ের শেষ পর্যন্ত দৌঁড়াইয়াছি, বিশ্বাস রক্ষা করিয়াছি। এখন অবধি আমার নিমিত্ত ধার্মিকতার মুকুট তোলা রহিয়াছে, প্রভু সেই ধর্মময় বিচারকর্তা, সেই দিন আত্মাকে তাহা দিবেন; কেবল আমাকে নয়, বরং যত লোক তাহার প্রকাশ প্রাপ্তি ভাল বাসিয়াছে সেই সকলকেও দিবেন।” ২ তীমথিয় ৪:৬—৮। AABen 431.2