খ্রীষ্টের দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা

12/61

শ্যামাঘাস

মথি ১৩:২৪-৩০, ৩৭-৪৩ পদের উপর ভিত্তি করে রচিত

“পরে তিনি তাহাদের নিকটে আর এক দৃষ্টান্ত উপস্থিত করিলেন, কহিলেন, স¦র্গ-রাজ্যকে এমন এক ব্যক্তির সহিত তুলনা করা যায়, যিনি আপন ক্ষেত্রে ভাল বীজ বপন করিলেন। কিন্তু লোকে নিদ্রা গেলে পর তাঁহার শত্রু আসিয়া ঐ গমের মধ্যে শ্যামাঘাসের বীজ বপন করিয়া চলিয়া গেল। পরে যখন বীজ অঙ্কুরিত হইয়া ফল দিল, তখন শ্যামাঘাসও প্রকাশ হইয়া পড়িল।” COLBen 54.1

খ্রীষ্ট বলেছেন, “এই ক্ষেত্র হচ্ছে জগৎ”। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এখানে মূলত জগতে অবস্থিত খ্রীষ্টের মণ্ডলীর কথাই বলা হয়েছে। এই দৃষ্টান্তটি প্রকাশ করে কারা প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের রাজ্যের অংশীদার হবে এবং কীভাবে খ্রীষ্ট মানুষের পরিত্রাণ সাধন করবেন। আর এই কার্য তিনি সাধন করবেন মণ্ডলীর মধ্য দিয়ে। এ কথা সত্যি যে, পবিত্র আত্মা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকটি স্থানে প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে তিনি বিরাজ করছেন। কিন্তু মণ্ডলীতেই আমরা বৃদ্ধি লাভ করব এবং ঈশ্বরের ক্ষেত্রের ফসল হিসেবে পরিপক্ব হয়ে উঠব। COLBen 54.2

“যিনি ভাল বীজ বপন করেন, তিনি মনুষ্যপুত্র . . . ভাল বীজ রাজ্যের সন্তানগণ; শ্যামাঘাস সেই পাপাত্মার সন্তানগণ।” ভাল বীজ নির্দেশ করে তাদেরকে যারা ঈশ্বর হতে ও সত্যে জন্মগ্রহণ করেছে। শ্যামাঘাস এমন এক শ্রেণীর মানুষকে নির্দেশ করে, যারা ভুল বা মিথ্যার নীতিতে চলে ও তা ধারণ করে। “যে শত্রু তাহা বুনিয়াছিল, সে দিয়াবল।” ঈশ্বর বা তাঁর স্বর্গদূতেরা কেউই এমন বীজ বোনেননি যে, তা থেকে শ্যামাঘাস উৎপন্ন হবে। শ্যামাঘাস সব সময় শুধু শয়তানই বপন করে, কারণ সে ঈশ্বর ও মানুষের শত্রু। COLBen 54.3

প্রাচ্যে অনেক সময় কোন মানুষ কারও উপরে প্রতিশোধ নিতে হলে তার শষ্য ক্ষেতে সদ্য বোনা বীজের ফাঁকে ফাঁকে বিষাক্ত বা আগাছা জাতীয় বীজ বুনে দিত। সেই বীজ থেকে চারা বেড়ে ওঠার সময়ও তা গমের চারা বলেই মনে হত। কিন্তু যখন সেই গমের চারা ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ রূপ নিত, তখন তার সাথে সাথে বেড়ে ওঠা আগাছাগুলো শস্যের ক্ষতি করত এবং তাতে করে ক্ষেতের মালিককে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হত। কাজেই শয়তান খ্রীষ্টের প্রতি শত্রুতা করে তাঁর রাজ্যের ভাল বীজের মধ্যে তার মন্দ বীজ বুনে দিয়েছে। তার বপনকৃত বীজ বৃদ্ধি পেয়েছে ঈশ্বরের পুত্রের বপনকৃত বীজের সাথে সাথে। খ্রীষ্টের নাম ধারণ করেও তাঁকে ব্যক্তিগত ত্রাণকর্তা হিসেবে গ্রহণ করেনি, এমন মন্দ মানুষ মণ্ডলীতে প্রবেশ করার কারণে ঈশ্বর অপমানিত হন, পরিত্রাণের কার্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়, এবং আত্মা বিনষ্ট হয়। COLBen 55.1

মণ্ডলীতে প্রকৃত ও ভ- বিশ্বাসীদের মিশ্রিত হতে দেখলে খ্রীষ্টের সেবকেরা মর্মাহত হন। তারা মণ্ডলীকে পরিষ্কৃত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। গৃহকর্তার দাসদের মত তারা গমের মধ্য থেকে শ্যামাঘাস উঠিয়ে ফেলার জন্য সদা প্রস্তুত হয়ে থাকেন। কিন্তু খ্রীষ্ট তাদেরকে বলছেন, “না, কি জানি, শ্যামাঘাস সংগ্রহ করিবার সময়ে তোমরা তাহার সহিত গমও উপড়াইয়া ফেলিবে। শস্যচ্ছেদনের সময় পর্যন্ত উভয়কে একত্রে বাড়িতে দেও।” COLBen 55.2

খ্রীষ্ট সুস্পষ্টভাবে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, যারা প্রকাশ্যে পাপ করে বেড়ায় তাদেরকে অবশ্যই মণ্ডলী থেকে বিতাড়িত করতে হবে, কিন্তু তিনি আমাদেরকে কারও চরিত্র ও কাজের বিচার করার অধিকার দেননি। তিনি খুব ভাল করেই জানেন যে, আমরা এই দায়িত্ব ভার গ্রহণ করার জন্য আসলে কতটুকু উপযুক্ত। যাদেরকে আমরা ভ- খ্রীষ্টিয়ান বলে মনে করে থাকি তাদেরকে যদি মণ্ডলী থেকে সমূলে উৎখাত করতেই হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই ভুল করব। আমরা অনেক সময় তাদেরকে অসহায় বলে মনে করে থাকি, যাদেরকে খ্রীষ্ট নিজে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা যদি ত্রুটিযুক্ত বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে এই আত্মাদের বিচার করি, তাহলে হয়তো তাদের অন্তরের আলো নিভে যাবে। যারা নিজেদেরকে খ্রীষ্টিয়ান বলে মনে করেন, তাদের অনেকের মধ্যেই ঘাটতি পাওয়া যাবে। এমন অনেকেই স্বর্গে যাবেন যাদেরকে সেখানে দেখা যাবে বলে তাদের প্রতিবেশীরা কখনো ভাবতেও পারেনি। মানুষ চেহারা দেখে বিচার করে, কিন্তু ঈশ্বর অন্তর দেখে বিচার করেন। ফসল কর্তনের সময় আসার আগ পর্যন্ত শ্যামাঘাস ও গম এক সাথে বাড়তে দেয়া হবে। COLBen 55.3

আর ফসল কাটার সময় আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই পরীক্ষামূলক সময় শেষ হবে। আমাদের ত্রাণকর্তার বক্তব্যে আরেকটি শিক্ষা পাওয়া যায়, যা এক চমৎকার তত্ত্বাবধান ও স্নেহবৎসল ভালবাসার শিক্ষা। শ্যামাঘাসের শিকড় যেমন খুব ঘনিষ্ঠভাবে ভাল চারার শিকড়ের সাথে জেঁকে বসে, তেমনি মণ্ডলীর ভ- ভাইরাও সত্যিকার শিষ্যদের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকে। এই সমস্ত তথাকথিত বিশ্বাসীদের প্রকৃত চরিত্র পুরোপুরিভাবে প্রকাশ পায় না। তাদেরকে যদি মণ্ডলী থেকে পৃক করতে হয়, তাহলে অন্যরা বিঘ্ন পাবে, যারা এক্ষেত্রে সেই ভ- বিশ্বাসীদের সাথে সাথে বিনষ্ট হবে। COLBen 56.1

মানুষ ও স্বর্গদূতদের প্রতি ঈশ্বরের নিজ মনোভাব ও আচরণ ফুটিয়ে তুলতে এই দৃষ্টান্তটি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। শয়তান হচ্ছে প্রবঞ্চক। সে যখন স্বর্গে পাপ করল, তখনও এমনকি বিশ্বস্ত স্বর্গদূতেরা তার চরিত্র পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেননি। এ কারণে ঈশ্বর শয়তানকে একবারে ধ্বংস করে দেননি। তিনি যদি এ কাজ করতেন, তাহলে পবিত্র স্বর্গদূতেরা ঈশ্বরের ন্যায় বিচার ও ভালবাসা অনুধাবন করতে পারতেন না। ঈশ্বরের মঙ্গলময়তার প্রতি সন্দেহ এমন এক মন্দ বীজ যা নিয়ে আসে শুধুই পাপ ও দুর্দশার তিক্ত ফল। এ কারণে মন্দতার জনককে ছেড়ে দেয়া হল, যেন সে তার চরিত্র পুরোপুরিভাবে বিকশিত করতে পারে। বহু কাল ধরে ঈশ্বর এই মন্দতার কার্য দেখতে দেখতে ক্ষোভ ও ক্রোধে পূর্ণ হয়ে উঠছেন। তিনি দুষ্টদের ভুল ব্যাখ্যার প্রলোভনে পতিত হতে না দিয়ে মানুষকে দিয়েছেন কালভেরীর অতুলনীয় উপহার। কারণ শ্যামাঘাস তুলতে গিয়ে মূল্যবান শস্যের শেকড় উপড়ে ফেলার আশঙ্কা সব সময়ই থেকে যায়। শয়তানের প্রতি স্বর্গ ও পৃথিবীর প্রভু যেমন ধৈর্য ধারণ করছেন তেমনি আমাদেরও কি চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এ ধরনের মানুষদের প্রতি ধৈর্য ধারণ করা উচিত নয়? COLBen 56.2

মণ্ডলীতে ভণ্ড খ্রীষ্টানদের উপস্থিতি রয়েছে বলে খ্রীষ্ট ধর্মের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করার কোন অধিকার যেমন এই পৃথিবীর নেই, তেমনি এই সমস্ত ভ- ভাইদের কারণে প্রকৃত খ্রীষ্টানদের দুঃখ করার কিছু নেই। আদি মণ্ডলীর অবস্থাটা কেমন ছিল? অননিয় ও সাফীরা শিষ্যদের দলে যোগ দিয়েছিল। শিমোন ম্যাগাস বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেছিল। দীমা পৌলকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল, যাকে এর পরও একজন বিশ্বাসী হিসেবে বিবেচনা করা হত। ইষ্কোরিয়োতীয় যিহূদাকে প্রেরিতদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। ত্রাণকর্তা একটি আত্মাকেও বিনষ্ট হতে দিতে চান না। বিকৃত মানবীয় স্বভাবের প্রতি তাঁর চরম সহিষ্ণুতার নিদর্শন প্রকাশের জন্যই যিহূদার ঘটনাটি আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি যেমন এই আচরণ সহ্য করে চলেছেন, একইভাবে তিনি আমাদেরকেও তা সহ্য করতে বলছেন। তিনি আমাদেরকে বলেছেন যে, শেষ সময় আসার আগ পর্যন্ত মণ্ডলীতে এই সমস্ত ভ- বিশ্বাসীদেরকে দেখা যাবে। COLBen 57.1

খ্রীষ্টের সতর্কবাণী দান করা সত্ত্বেও মানুষ এই শ্যামাঘাস উপড়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। যারা মন্দ কার্য সাধনকারী হিসেবে নিজেদেরকে প্রকাশ করেছে তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য মণ্ডলী পার্থিব ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। যারা প্রতিষ্ঠিত মতবাদ থেকে নিজেদেরকে পৃক করতে চেয়েছে তাদেরকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে ও হত্যা করা হয়েছে সেই সমস্ত মানুষের আদেশে, যারা নিজেদেরকে খ্রীষ্টের অনুমোদিত বিচারকর্তা হিসেবে দাবী করেছে। কিন্তু এ ধরনের কাজের পেছনে যা ইন্ধন যোগায় তা কোনভাবেই খ্রীষ্টে আশ্রিত আত্মা হতে পারে না, বরং তা শয়তানের আত্মা। এটিই পুরো পৃথিবীকে নিজ কর্তৃত্বের অধীনে নিয়ে আসার জন্য শয়তানের দুরভিসন্ধি। যারা মণ্ডলীর নিয়মের থেকে আলাদা পথে চলতে চেয়েছে তাদের দ্বারা ঈশ্বরকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। COLBen 57.2

খ্রীষ্টের এই দৃষ্টান্তের নিগূঢ় শিক্ষা বিচার ও শাস্তি নয়, বরং ন¤্রতা ও নিজেকে নিয়ে গর্ব না করা। মাঠে যে সমস্ত বীজ বোনা হয়েছে সেগুলোর সবই ভালো বীজ নয়। মানুষ মণ্ডলীতে রয়েছে বলেই তাদেরকে খ্রীষ্টিয়ান বলে প্রমাণ করা যায় না। COLBen 57.3

পাতাগুলো যখন সবুজ থাকে তখন গম আর শ্যামাঘাস দেখতে একই রকম মনে হয়; কিন্তু ফসল কাটার সময় গমের পুরো মাঠ যখন সাদা হয়ে উঠল, তখন গমের পরিপুষ্ট ও পাকা শীষের সাথে মূল্যহীন শ্যামাঘাসের পার্থক্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল। যে সমস্ত পাপীরা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে প্রচার করতে চায়, তারা কিছু কালের জন্য খ্রীষ্টের প্রকৃত অনুসারীদের মধ্যে মিশে থাকে, এবং ধার্মিক খ্রীষ্টিয়ানের লেবাস পরে তারা বহু মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে যখন শস্য কর্তনের সময় এসে উপস্থিত হবে তখন উত্তম ও মন্দের মাঝে আর কোন মিলই থাকবে না। তখন যারা মণ্ডলীতে যোগ দিয়েছিল কিন্তু খ্রীষ্টেতে মিলিত হয়নি, তাদের স্বরূপ প্রকাশিত হবে। COLBen 58.1

গমের সাথে শ্যামাঘাসগুলো বেড়ে উঠতে সুযোগ দেয়া হয়েছে, যেন দুটোই রোদ ও বৃষ্টি পায়। কিন্তু শস্য কর্তনের সময় “তখন তোমরা ফিরিয়া আসিবে, এবং ধার্মিক ও দুষ্টের মধ্যে, যে ঈশ্বরের সেবা করে, ও যে তাঁহার সেবা না করে, উভয়ের মধ্যে প্রভেদ দেখিবে,” মালাখি ৩:১৮। স্বয়ং খ্রীষ্ট ঠিক করবেন কে আসলে স্বর্গে তাঁর পরিবারের সাথে বসবাস করার উপযুক্ত। তিনি প্রত্যেকটি মানুষকে তার কথা ও কাজের ভিত্তিতে বিচার করবেন। এই মাপকাঠিতে মানুষের পদমর্যাদা কিছুই নয়। মানুষের চরিত্রই তার নিয়তি নির্ধারণ করবে। COLBen 58.2

খ্রীষ্ট এমন কোন সময়ের কথা এখানে বলছেন না, যখন সমস্ত শ্যামাঘাস গমে রূপান্তরিত হবে। শস্য কর্তনের আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ পৃথিবীর শেষ কাল পর্যন্ত গম ও শ্যামাঘাস এক সাথে বাড়তে থাকবে। এরপর সমস্ত শ্যামাঘাস আঁটি বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হবে এবং গম কেটে ঈশ্বরের গোলাঘরে জড়ো করা হবে। “তখন ধার্মিকেরা আপনাদের পিতার রাজ্যে সূর্যের ন্যায় দেদীপ্যমান হইবে।” তখন “মনুষ্যপুত্র আপন দূতগণকে প্রেরণ করিবেন; তাঁহারা তাঁহার রাজ্য হইতে সমস্ত বিঘ্নজনক বিষয় ও অধর্মাচারীদিগকে সংগ্রহ করিবেন, এবং তাহাদিগকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলিয়া দিবেন; সেই স্থানে রোদন ও দন্তঘর্ষণ হইবে।” COLBen 58.3