খ্রীষ্টের দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা

10/61

উত্তম ভূমি

বীজবাপককে প্রত্যেকবারই যে হতাশ হতে হবে তা নয়। যে বীজ উত্তম ভূমিতে পতিত হবে সে সম্পর্কে ত্রাণকর্তা বলেছেন, “এ সেই, যে সেই বাক্য শুনিয়া তাহা বুঝে, সে বাস্তবিক ফলবান হয়, এবং কতক শত গুণ, কতক ষাট গুণ, ও কতক ত্রিশ গুণ ফল দেয়।” “যাহা উত্তম ভূমিতে পড়িল তাহা এমন লোক, যাহারা সৎ ও উত্তম হৃদয়ে বাক্য শুনিয়া ধরিয়া রাখে এবং ধৈর্য সহকারে ফল উৎপন্ন করে।” COLBen 43.1

এই দৃষ্টান্তে “সৎ ও উত্তম” যে হৃদয়ের কথা বলা হয়েছে তা এমন হৃদয় নয় যাতে কোন পাপ নেই; কারণ যারা হারিয়ে গেছে সুসমাচার তাদেরই জন্য। খ্রীষ্ট বলেছেন, “আমি ধার্মিকদিগকে নয়, কিন্তু পাপীদিগকেই ডাকিতে আসিয়াছি,” মার্ক ২:১৭। যে ব্যক্তি পবিত্র আত্মার আহ্বানে সাড়া দেয় তার অন্তর সৎ। সে তার অপরাধ স্বীকার করে এবং তার যে ঈশ্বরের দয়া ও ভালবাসার প্রয়োজন রয়েছে তা অনুভব করে। সত্যকে জানার জন্য ও তা পালন করার জন্য তার এক আন্তরিক ইচ্ছা রয়েছে। উত্তম হৃদয় হচ্ছে বিশ্বাসীর হৃদয়, যে হৃদয়ের ঈশ্বরের বাক্যের উপরে বিশ্বাস রয়েছে। বিশ্বাস ব্যতীত ঈশ্বরের বাক্য গ্রহণ করা অসম্ভব বিষয়। “কিন্তু বিনা বিশ্বাসে প্রীতির পাত্র হওয়া কাহারও সাধ্য নয়; কারণ যে ব্যক্তি ঈশ্বরের নিকটে উপস্থিত হয়, তাহার ইহা বিশ্বাস করা আবশ্যক যে ঈশ্বর আছেন, এবং যাহারা তাঁহার অনে¡ষণ করে, তিনি তাহাদের পুরস্কারদাতা।” ইব্রীয় ১১:৬। COLBen 43.2

এ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে সেই বাক্য শোনে এবং তা বুঝে। খ্রীষ্টের সময়কার ফরীশীরা তাদের চোখ বন্ধ করে রাখত, পাছে তারা দেখে। তারা তাদের কান বন্ধ করে রাখত, পাছে তারা শুনতে পায়। এ কারণে সত্য কখনো তাদের অন্তরে গিয়ে পৌছতে পারত না। তারা তাদের ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছা প্রণোদিত অন্ধত্বের কারণে ঈশ্বরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু খ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদের শিখিয়েছেন যেন তাঁরা ঈশ্বরের আদেশ গ্রহণ করার জন্য তাঁদের অন্তর উন্মুক্ত রাখেন এবং বিশ্বাস করতে প্রস্তুত থাকেন। তিনি তাদের উপরে এক বিশেষ আশীর্বাদ দান করেছিলেন, কারণ তারা চোখ দিয়ে যা দেখতেন, ও কান দিয়ে যা শুনতেন তা বিশ্বাস করতেন। COLBen 44.1

উত্তম ভূমির মত শ্রোতারা সেই বাক্যকে “মানুষের বাক্য বলিয়া নয়, কিন্তু এতে সত্য নিহিত আছে ও ঈশ্বরের বাক্য বলিয়া তাহা গ্রহণ করিয়াছিলে; তাহা ঈশ্বরের বাক্যই বটে।” ১ থিষলনীকীয় ২:১৩। যিনি পবিত্র শাস্ত্রকে ঈশ্বরের মুখ হতে নিসৃত বাক্য হিসেবে গ্রহণ করেন, তিনিই পবিত্র শাস্ত্রের ও ঈশ্বরের বাক্যের প্রকৃত শিক্ষার্থী। কর্ণীলিয় ও তাঁর বন্ধুরা ছিলেন এ ধরনের মানুষ, যিনি প্রেরিত পিতরকে বলেছিলেন, “এই নিমিত্ত আমি অবিলম্বে¦ আপনার নিকটে লোক পাঠাইয়া দিলাম; আপনি আসিয়াছেন, ভালই করিয়াছেন। অতএব এখন আমরা সকলে ঈশ্বরের সাক্ষাতে উপস্থিত আছি; প্রভু আপনাকে যে সকল আদেশ করিয়াছেন, তাহা শুনিব।” প্রেরিত ১০:৩৩। COLBen 44.2

এই সত্যের জ্ঞান কোন মানবীয় বুদ্ধিমত্তা বা শক্তির উপরে নির্ভর করে না; বরং তা নির্ভর করে অন্তরের সারল্য ও বিশ্বাসের দৃঢ়তার উপরে। যারা নম্রতার মধ্য দিয়ে স্বর্গীয় দিক নির্দেশনার যাচ্ঞা করে, ঈশ্বরের দূত তাদের নিকটে আসেন। পবিত্র আত্মা তাদের সামনে স্বর্গীয় জ্ঞানের ঐশ্বর্য ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেন। COLBen 44.3

উত্তম ভূমির মত যে সমস্ত শ্রোতারা, তার বাক্য শ্রবণ করার পর তা রেখে দেন। শয়তান তার সমস্ত মন্দতার শক্তি নিয়েও তা ছিনিয়ে নিতে পারে না। COLBen 44.4

শুধু বাক্য শ্রবণ করা বা তা পাঠ করাই যথেষ্ট নয়। যে ব্যক্তি পবিত্র শাস্ত্রের দ্বারা উপকৃত হতে চায়, তাকে অবশ্যই সেই সত্য ধ্যান করতে হবে যা তার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। একাগ্র মনোযোগ ও প্রার্থনার সাথে ধ্যান করার মধ্য দিয়ে সত্যের বাক্যের অর্থ আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হব এবং পবিত্র আত্মার দান আমাদের জীবনে গ্রহণ করতে পারব। COLBen 44.5

ঈশ্বর আমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন যেন আমরা আমাদের অন্তরকে মহত্তর চিন্তায় পরিপূর্ণ করি, শুদ্ধ চিন্তায় পূর্ণ করি। তিনি চান যেন আমরা তাঁর ভালবাসা ও করুণা ধ্যান করি, পরিত্রাণের পরিকল্পনা ও তাঁর অপূর্ব কাজের ধ্যান করি। তখন আমরা আরও স্পষ্টভাবে এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারব এবং আমাদের অন্তর আরও শুদ্ধ হবে ও চিন্তা আরও পরিশীলিত হবে। যে আত্মা পবিত্র চিন্তাধারার পরিবেশে অবস্থান করে, তা সরাসরি ঈশ্বরের সাথে সংযুক্ত হতে পারে। এই পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব একমাত্র পবিত্র শাস্ত্র অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে। COLBen 45.1

“আর ফল দান করে।” যারা সেই বাক্য শোনে, তা অন্তরে ধারণ করে, তারা অবশ্যই বাধ্যতায় তার ফল বয়ে নিয়ে আসবে। ঈশ্বরের বাক্য যখন আমরা আমাদের অন্তরে ধারণ করি তখন তা ভাল কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। তা যীশুর মত চরিত্র ও জীবনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। খ্রীষ্ট নিজে তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “হে আমার ঈশ্বর, তোমার অভীষ্ট সাধনে আমি প্রীত, আর তোমার ব্যবস্থা আমার অন্তরে আছে।” গীতসংহিতা ৪০:৮। “আমি আপনা হইতে কিছুই করিতে পারি না; যেমন শুনি তেমনি বিচার করি; আর আমার বিচার ন্যায্য, কেননা আমি আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করি না, কিন্তু আমার প্রেরণকর্তার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করি।” যোহন ৫:৩০। আর পবিত্র শাস্ত্র বলে, “যে বলে, আমি তাঁহাতে থাকি, তাহার উচিত যে তিনি যেরূপ চলিতেন, সেও তদ্রপ চলে।” ১ যোহন ২:৬। COLBen 45.2

ঈশ্বরের বাক্যের সাথে অনেক সময় মানবীয় রীতি নীতি ও তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা ও মতাদর্শ এবং জীবন আচরণ ও অভ্যাসের মধ্যে সংঘাত হয়। কিন্তু উত্তম ভূমির মত শ্রোতারা বাক্য অন্তরে ধারণ করে এবং তার সমস্ত শর্ত পালন করে। তার অভ্যাস, সংস্কার ও রীতি নীতি সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের বাক্যের অধীনস্থহয়। তার দৃষ্টিতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বাক্যের কাছে সসীম মানুষের আইন কানুন, বিধান ও আদেশ, প্রথা ও রীতি নীতি সবই গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হয়। পরিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে, অদম্য উৎসাহ নিয়ে সে অনন্ত জীবনের অন্বেষণ করে এবং নিপীড়ন, নির্যাতন, এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত উপেক্ষা করে সে এই সত্য পালনে ব্রতী হয়। COLBen 45.3

সে “ধৈর্য সহকারে” ফল দান করে। যে কেউ ঈশ্বরের বাক্য গ্রহণ করে তাকে অবশ্যই সমস্যা ও পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে; কিন্তু যখন নির্যাতন নেমে আসে, তখন একজন সত্যিকারের খ্রীষ্টান অশান্ত, অবিশ্বস্ত বা নির্জীব হয়ে পড়েন না। যদিও আমরা ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ সম্পূর্ণ ভাবে জানতে বা দেখতে পাই না, তথাপি তার উপরে থেকে আমাদের বিশ্বাস বিচ্যুত করা যাবে না। আমরা যদি প্রভুর অপার ভালবাসার কথা স্মরণ করি তাহলে আমরা ধৈর্য সহকারে তাঁর উপরে নির্ভর করতে পারব এবং তাঁর পরিত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে পারব। COLBen 46.1

সংঘাতের মুখে পড়ে আত্মিক জীবন আরও শক্তিশালী হয়। পরীক্ষা আমাদের চরিত্রের দৃঢ়তা বাড়িয়ে দেয় এবং আমাদের মূল্যবান আত্মিক অনুগ্রহকেও বৃদ্ধি দান করে। বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় ফল মৃদুতা ও ভালবাসা অনেক সময় ঝড়োন্মুখ আবহাওয়া এবং অন্ধকার মেঘের মাঝেই পরিপক্বতা লাভ করে। COLBen 46.2

“অতএব হে ভ্রাতৃগণ, তোমরা প্রভুর আগমন পর্যন্ত দীর্ঘসহিষ্ণু থাক। দেখ, কৃষক ভূমির বহুমূল্য ফলের অপেক্ষা করে এবং যত দিন তাহা প্রথম ও শেষ বর্ষা না পায়, ততদিন তাহার বিষয়ে দীর্ঘসহিষ্ণু থাকে।” যাকোব ৫:৭। কাজেই খ্রীষ্টানদের ঈশ্বরের বাক্য অনুসারে তার জীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে। অনেক সময় আমরা আত্মার অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রার্থনা করি। আর তাতে ঈশ্বর আমাদের এই প্রার্থনার উত্তর দেন আমাদেরকে এমন অবস্থানে উপনীত করার মধ্য দিয়ে যেখানে আমরা নিজেরাই আমাদের এই অনুগ্রহের ফলের আরও উন্নতি সাধন করতে পারব। কিন্তু আমরা তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পারি না, বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি এবং তাঁকে ভুল বুঝি। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ঈশ্বরের বাক্য গ্রহণ করা এবং তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা, আমাদের নিজেদেরকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে কঠিন ভাবে ধরে রাখা এবং তাঁর পরিকল্পনা আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত হতে দেয়া। COLBen 46.3

প্রভু যীশু খ্রীষ্ট বলেছেন, “কেহ যদি আমাকে প্রেম করে, তবে সে আমার বাক্য সকল পালন করিবে; আর আমার পিতা তাহাকে প্রেম করিবেন, এবং আমরা তাহার নিকটে আসিব ও তাহার সহিত বাস করিব।” যোহন ১৪:২৩। আমাদের অন্তর আরও বেশি শক্তিশালী ও বিশ্বাসে দৃঢ় হয়ে উঠবে। কারণ সর্বশক্তিমানের সাথে আমাদের তখন এক জীবন্ত সংযোগ স্থাপিত হবে। আমাদের আত্মিক জীবনে আমরা যীশু খ্রীষ্টের বন্দী হব। আমরা আর নিজেদের স্বার্থপর সাধারণ মানব জীবন যাপন করব না, বরং খ্রীষ্ট আমাদের মাঝে বাস করবেন। তাঁর চরিত্র আমাদের স্বভাবে প্রতীয়মান হবে। এভাবেই আমরা পবিত্র আত্মার ফল ধারণ করতে পারব - ” কতক ত্রিশ গুণ, কতক ষাট গুণ, ও কতক শত গুণ।” COLBen 47.1