সুষম শিক্ষা
২৭ - আচরণ
“প্রেম... অশিষ্টাচারণ করে না।”
শিষ্টাচারের মূল্য খুব অল্পই প্রদান করা হয়ে থাকে। অনেকে আছেন যাদের হৃদয়ে দয়া-মায়া আছে কিন্তু তাদের মধ্যে দয়ার আচরণের অভাব রয়েছে। অনেকে তাদের সরলতা এবং ন্যায়পরায়ণতা দ্বারা সমাদরের দাবি রাখেন কিন্তু দুঃখজনক ভাবে তাদের মধ্যে অমায়িকতার অভাব রয়েছে। এই অভাব তাদের নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করে এবং তারা অন্য লোেকদের সেবা ও পরিচর্যা করতে ব্যর্থ হয়। জীবনের অনেক মাধুর্য এবং খুবই কার্যকর অভিজ্ঞতা, প্রায়ই চিন্তাশীলতার অভাবের দরুণ অসৌজন্য ব্যবহার দ্বারা জলাঞ্জলি দেয়া হয়ে থাকে। EdBen 222.1
বাবা-মা, অভিভাবক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাকে প্রফুল্লতা এবং সৌজন্যমূলক ব্যবহার করতে হবে। সবাই একটি প্রফুল্লচিত্ত, একটি কোমল স্বর, এবং সৌজন্য ব্যবহারের অধিকারী হতে পারেন এবং এ সবই শক্তির মূল বিষয়বস্তু। ছােট ছােট ছেলে-মেয়েরা একটি প্রফুল্লিত এবং হাসি-খুশি আচরণ ও মনােভাব দ্বারা আকর্ষিত হয়ে থাকে। তাদের প্রতি দয়া ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করুন, এবং একইভাবে তারাও আপনার এবং একে অন্যের প্রতি একইরূপ মনােভাব দেখাবে EdBen 222.2
প্রকৃত সদয় ভাব কেবল আদব-কায়দার আইন-কানুন অভ্যাস দ্বারা শিক্ষা করা যায় না। সব সময়ে আচরণের শােভনতা দেখাতে হবে; যেখানে নীতির সঙ্গে আপােষ করা যাবে না, সেখানে অপরের বিবেচনা গৃহীত রীতি-নীতি পরের ইচ্ছাপূরণে পরিচালনা প্রদান করবে; কিন্তু প্রকৃত শিষ্টাচার, চলিত রীতি নীতি অনুসরণ দ্বারা নীতিকে বিসর্জন দেয়া যাবে না। এটা জাতিভেদে প্রথা উপেক্ষা করে। এটা আত্ম-সম্মান, মানব মূল্যবােধ, মহান মানব ভ্রাতৃত্বের প্রতিটি সভ্যের প্রতি শ্রদ্ধা শিক্ষা দেয়। EdBen 222.3
কেবল আচার-আচরণ এবং রীতি-নীতির উপর অত্যধিক মূল্য আরােপ, এবং এ বিষয়ে শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে অত্যধিক সময় কাটানােতে বিপদ রয়েছে। প্রত্যেক যুবক-যুবতির কাছ থেকে তীব্র প্রচেষ্টায় জীবনের দাবী করা হয়েছে এমন কি জীবনের সাধারণ কাজের দায়িত্বের জন্যও প্রায়ই প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খায় না এমন কাজের জন্য কঠিন প্রচেষ্টার আবশ্যকতা দেখা দেয়, এবং বিশ্বের মূর্খতা এবং দুর্ভাগ্যের ভারী বােঝা লাঘবের ক্ষেত্রেও এটি অবশ্যই এ সব চলিত রীতি-নীতির ক্ষেত্রেও এর স্থান খুবই সামান্য। EdBen 223.1
অনেকে যারা শিষ্টাচারের উপরে বেশি গুরুত্ব দেয়, যারা যে কোন বিষয়ের প্রতি খুব অল্পই শ্রদ্ধা দেখিয়ে থাকেন, সে যতই চমৎকার হােক না কেন, তা তাদের কৃত্রিম মনের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। এটি একটি ভুল শিক্ষা। এটি সমালােচনাকর অহঙ্কার এবং সংকীর্ণমনা স্বাতন্ত্র পােষণ করে । EdBen 223.2
প্রকৃত ভদ্রতার অপরিহার্য মূল বিষয় হল অপরের জন্য চিন্তা ভাবনা করা। অত্যাবশ্যকীয় স্থায়ী শিক্ষা এমন কিছু যা সহানুভূতি এবং দরদ বাড়িয়ে তােলে এবং বিশ্ব প্রেম উৎসাহিত করে। কথিত কষ্টি বা সভ্যতা যা যুবক-যুবতিকে তার অভিভাবকদের কাছে সবার চেয়ে ব্যতিক্রম, তাদের উৎকর্ষতার প্রশংসা মূলক, তারা দুর্বলতার প্রতি ধৈর্যশীল, এবং তাদের। চাহিদাগুলাের সহায়ক করে তােলে না, যা যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এবং দুর্ভাগাদের প্রতি তাকে বিবেচক, স্ত্র, এবং এমন কি সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করে না, এটি একটি ব্যর্থতা । EdBen 223.3
ঐশ্বরিক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিদ্যালয়ে চিন্তা এবং শিষ্টাচারের প্রকৃত বিশুদ্ধি অন্যান্য পালিত নিয়ম কানুনের চেয়ে বেশি শেখা যায়। হৃদয়ে ছড়িয়ে পদ্য তাঁর প্রেম চরিত্রে ঐ সব বিশুদ্ধিকরণ স্পর্শ দান করে যা হৃদয়কে তার নিজ অনুরূপতায় গঠন করে। এই স্বভাবের মিষ্টতা এবং শিষ্টাচারের নম্রতা দান করে যা প্রচলিত রীতি-নীতি অনুসরণকারী সমাজের ভাসা ভাসা চাকচিক্যের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। EdBen 223.4
বাইবেল শিষ্টাচারের নির্দেশ প্রদান করে, এবং এটি নিঃস্বার্থ মনোভাব, তার মাধুর্যের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে, যা প্রকৃত ভদ্রতা, এবং নম্রতার রূপ দান করে। এটি খ্রীষ্টের স্বভাবের প্রতিবিম্ব । পৃথিবীর প্রকৃত নম্রতা এবং শিষ্টাচার, এমন কি যারা তার নাম জানে না, তাদের সবই তাঁর কাছ থেকে আসে। আর তিনি আশা করেন যেন তার সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে নিখুঁৎ ভাবে চরিত্রের বৈশিষ্টগুলাে প্রতিবিম্বিত হয়। এটি তার উদ্দেশ্য যেন লোকেরা আমাদের মধ্যে তার সৌন্দর্য দেখতে পারে। EdBen 223.5
শিষ্টাচার সম্পর্কে অতি মূল্যবান প্রবন্ধগুলাে ত্রাণকর্তা কর্তৃক মূল্যবান শিক্ষামালার মধ্যে দেয়া হয়েছে, যা আর কখনাে দেয়া হয় নি এবং যা তিনি পবিত্র আত্মার সাহায্যে পৌলের মাধ্যমে দিয়েছেন যা প্রত্যেক নরনারী, যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মনে লেখা থাকবে। EdBen 224.1
“আমি যেমন তােমাদিগকে প্রেম করিয়াছি, তােমরাও তেমনি পরস্পর প্রেম কর।” যােহন ১৩:৩৪। EdBen 224.2
“প্রেম চিরসহিষ্ণু, প্রেমা মধুর, ঈর্ষা করে না,
প্রেম আত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব করে না,
অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থ চেষ্টা করে না, রাগিয়া উঠে না,
অপকার গণনা করে না, অধার্মিকতায় আনন্দ করে না,
কি সত্যের সহিত আনন্দ করে; সকলই বহন করে,
সকলই বিশ্বাস করে, প্রত্যাশা করে, সকলই ধৈর্যপূর্বক সহ্য করে। প্রম
কখনও শেষ হয় না।”
EdBen 224.3
১ করিন্থীয় ১৩:৪-৮।
আরও একটি চমৎকার মাধুর্য, যা সতর্কতার সঙ্গে লালন-পালন করতে হবে- তা সমাদর বা ভক্তি। ঈশ্বরের জন্য প্রকৃত সমাদর তাঁর অসীম মহত্ব এবং তার সান্নিধ্যের একটি উপলব্ধি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। অদৃশ্য ব্যক্তির এই অনুভূতি দ্বারা প্রতিটি শিশুর হৃদয় গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত হবে। ছােট ছােট ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে, প্রার্থনার এবং উপাসনার সময় এবং স্থান পবিত্র; কেননা ঈশ্বর সেখানে বর্তমান। মনােভাব এবং আচরণে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে, এবং এতে এক গভীর অনুভূতি সৃষ্ট হবে। EdBen 224.4
যুবক-যুবতি এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পক্ষে এটি অধ্যয়ন, ধ্যান করা, এবং অহরহ পবিত্র লেখনী পুনরাবৃত্তি করা উত্তম কাজ হবে; যা দেখিয়ে দেবে ঈশ্বরের উপস্থিতির মাধ্যমে চিহ্নিত স্থানের প্রতি কিভাবে শ্রদ্ধা দেখানাে উচিত। EdBen 224.5
“তােমার পদ হইতে জুতা খুলিয়া ফেল” তিনি জ্বলন্ত ঝােপ থেকে। মােশিকে আদেশ করলেন; “কেননা যে স্থানে তুমি দাঁড়াইয়া আছ, উহা পবিত্র ভূমি।” যাত্রাপুস্তক ৩:৫ । EdBen 225.1
দূতের দর্শন লাভের পর যাকোব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, “অবশ্য এই স্থানে সদাপ্রভু আছেন, আর আমি তা জ্ঞাত ছিলাম না। ... এ। কেমন ভয়বাহ স্থান! এ নিতান্তই ঈশ্বরের গৃহ, এ স্বর্গের দ্বার।” আদিপুস্তক ২৮:১৬, ১৭। EdBen 225.2
“কিন্তু সদাপ্রভু আপন পবিত্র মন্দিরে আছেন, সমস্ত পৃথিবী তাঁহার সম্মুখে নীরব থাক।” হবকূক ২:২০। EdBen 225.3
“কেননা সদাপ্রভু মহান ঈশ্বর,
তিনি সমুদয় দেবতার উপরে মহান রাজা।...
আইস, আমরা প্রণিপাত করি, প্রণত হই,
আমাদের নির্মাতা সদাপ্রভুর সাক্ষাতে জানু পাতি।”
“তিনিই আমাদিগকে নির্মাণ করিয়াছেন,
আমরা তাঁহারই; আমরা তাহার প্রজা ও তাঁহার চরাণির মেষ।
তােমরা স্তব সহকারে তাহার দ্বারে প্রবেশ কর,
প্রশংসা সহকারে তাহার প্রাঙ্গণে প্রবেশ কর;
তাহার স্তব কর, তাহার নামের ধন্যবাদ কর।”
EdBen 225.4
-গীতসংহিতা ৯৫:৩-৬; ১০০:৩, ৪।
ঈশ্বরের নামের প্রতিও সমাদর প্রদর্শন করতে হবে । ঐ নামটি কখনাে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারণ বা চিন্তা করা যাবে না। এমনকি প্রার্থনায় বারংবার অথবা নিপ্রয়ােজনে পুনরুক্তি এড়িয়ে চলতে হবে । “তাহার নাম পবিত্র এবং ভয়াবহ।” গীতসংহিতা ১১১:৯। দূতগণ, কথা বলার সময়ে তাদের মুখমণ্ডল আচ্ছাদন করেন। তা হলে, আমাদের ন্যায় পতিত এবং পাপপূর্ণ মানবের মুখে তার নাম উচ্চারণে আরও কত-ই-না অধিক সমাদর প্রদর্শন করা এবং সতর্ক হওয়া উচিত! EdBen 225.5
আমাদেরকে ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। ছাপানাে বই-পুস্তকগুলাে আমরা সমাদরের চোখে দেখব, তা কখনাে গতানুগতিক ভাবে ব্যবহার অথবা অসতর্ক হাত দিয়ে ধরা যাবে না এবং কখনাে শাস্ত্র একটি ঠাট্টা বা মস্করা করার উদ্দেশে উদ্ধৃত করা অথবা হাস্যরসাত্মক ভাবে শব্দান্তরিত করা যাবে না। “ঈশ্বরের প্রত্যেক বাক্য পরীক্ষাসিদ্ধ;” “তাহা মৃত্তিকার মুচিতে খাটি করা রৌপ্যের তুল্য, সাতবার পরিষ্কৃত রৌপ্যের তুল্য।” হিতােপদেশ ৩০:৫; গীতসংহিতা ১২:৬ । EdBen 225.6
সর্বোপরি, শিশুদের শেখাতে হবে যে, বাধ্যতার মাধ্যমেই প্রকৃত সম্মান দেখানাে হয়ে থাকে। ঈশ্বর এমন কিছু আদেশ করেন নি, যা অনাবশ্যক; এবং তার কথিত বাক্যের প্রতি সম্মান দেখানাে ছাড়া আর কোন উপায়ে তাকে সম্মান দেখাতে এবং সুখি করতে পারি না । EdBen 226.1
ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, কেননা সুসমাচার প্রচারকগণ, শিক্ষক-শিক্ষিকা, এবং বাবা-মা বা অভিভাবকেরা তাঁর পক্ষে কথা বলবার জন্য আহত হয়েছেন। তাদের প্রতি সম্মান দেখানােতে তিনিও সম্মানিত হন। EdBen 226.2
আর ঈশ্বর বিশেষ ভাবে প্রাচীনদের প্রতি প্রেম পরায়ণ সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ প্রদান করছেন। তিনি বলেন, “পকৃ কেশ শােভার মুকুট; তাহা ধার্মিকতার পথে পাওয়া যায়। এটি সংঘটিত যুদ্ধ, এবং বিজয়ের কথা বলে বােঝা বহন, এবং প্রলােভন প্রতিহত করার কথা বলে। বিশ্রামে গমনকারী ক্লান্ত চরণ খুব শিঘ্রই শূন্য হবে এমন এমন স্থানের কথা বলে। ছেলে-মেয়েদের এই বিষয়ে চিন্তা করতে সাহায্য করুন এবং তারা তাদের সদয় ব্যবহার এবং সম্মানের মাধ্যমে প্রাচীনদের পথ মসৃণ করবে, এবং তারা এই আদেশের প্রতি মনােযােগ দিয়ে তাদের নবীন জীবনে মাধুর্য বয়ে আনবে- “তুমি পকূকেশ প্রাচীনের সম্মুখে উঠিয়া দাঁড়াইবে, বৃদ্ধ লােককে সমাদর করিবে।” লেবীয় ১৯:৩২। EdBen 226.3
ঈশ্বর, বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি শিশুদরে জন্য তার যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তার প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা দেখাবেন। প্রতিদিন শিশুদের সংস্পর্শে এসে তারা যে চরিত্র তুলে ধরবেন, তার মাধ্যমে হয়। তাদের প্রতি মঙ্গল অথবা অমঙ্গল বয়ে আনবেন- “পিতা সন্তানদের প্রতি যেমন করুণা করেন, যাহারা সদাপ্রভুকে ভয় করে, তাহাদের প্রতি তিনি তেমনি করুণা করেন।” গীতসংহিতা ১০৩:১৩। “মাতা যেমন আপন পুত্রকে সান্ত্বনা করে, তেমনি আমি তােমাদিগকে সান্তনা করিব।” যিশাইয় ৬৬:১৩। EdBen 226.4
সেই শিশু সুখি যার মধ্যে এই কথাগুলাে—প্রেম-কৃতজ্ঞতানির্ভরশীলতা জাগিয়ে তােলে; যে শিশুর প্রতি বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা কোমল ব্যবহার ন্যায়বিচার, দীর্ঘ সহিষ্ণুতায় ঈশ্বরের প্রেম এবং ন্যায় বিচার ব্যাখ্যা করবেন; যে শিশু তার পার্থিব রক্ষাকারীদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করবে, শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে সে তার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে এবং তার আজ্ঞাবহ হতে, এবং তার প্রতি সমাদর প্রদর্শন করতে শিখবে। যিনি শিশু অথবা ছাত্র-ছাত্রীর সাথে এমন একটি উপহারের সহভাগি করেন, তিনি তাকে একটি ঐশ্বর্য প্রদান করেছেন যা পার্থিব সব ধনৈশ্বর্যের চেয়েও মূল্যবান, যে ঐশ্বর্য চিরকাল স্থায়ি হবে। EdBen 227.1