পরম ধন্য আশা
১ - মন্দের উৎপত্তি
অনেকের মতে পাপের উৎপত্তি এবং তাঁর অস্তিত্বের কারণ হচ্ছে এক মহা জটিলতার উৎস। তারা মন্দের কাজ লক্ষ্য করেন, যার ভয়ঙ্কর পরিণাম হল শােক, দুঃখ ও বিনাশ, আর তারা এই ভেবে সন্দেহ প্রকাশ করেন যে যিনি জ্ঞানে, ক্ষমতায় এবং প্রেমে অসীম, তাঁর সার্বভৌমত্বে কি করে এই সবের অস্তিত্ব থাকতে পারে। এখানেই এক রহস্য যার ব্যাখ্যা তারা খুঁজে পান না। আর তারা তাদের অনিশ্চয়তা ও সন্দেহের কারণে সরলভাবে প্রকাশিত ঈশ্বরের বাক্য এবং পরিত্রাণের জন্য তাঁর প্রয়ােজনীয়তা বুঝতে অসমর্থ হয়। কেউ কেউ আছেন যারা পাপের অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন কিছুর খোজ পান যা ঈশ্বর কখনাে প্রকাশ করেন নি; তাই তারা সমস্যাগুলাের কোন সমাধান খুঁজে পান না; আর তারা সন্দেহের ও খুঁত ধরার প্রবণতায় অনুপ্রাণিত হয়ে পবিত্র শাস্ত্রের বাক্যসমূহ অগ্রাহ্য করার অজুহাত খুঁজে পান। অন্য আর এক প্রকারের লােক আছেন তারা প্রথাগত কারণে এবং বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের চরিত্র ও তাঁর প্রশাসনের ধরণ এবং পাপের সম্বন্ধে ও তাঁর নীতিসমূহের ভুল ব্যাখ্যা এবং অস্পষ্টতার কারণে পাপের মহা সমস্যা সম্পর্কে সন্তোষজনক জ্ঞান লাভ করতে ব্যর্থ হন। GrHBen 15.1
পাপের উৎপত্তি ও তাঁর অস্তিত্বের কারণ দেখিয়ে তাঁর সপক্ষে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তথাপি পাপের প্রতি ঈশ্বরের প্রতিক্রিয়াসমূহ এবং তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও হিতৈষী মনােভাব পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে, যার মাধ্যমে পাপের উৎপত্তি এবং তাঁর শেষ পরিণতি ও ভয় সম্পর্কে হয়ত বােঝা যেতে পারে । GrHBen 15.2
পাপের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে যদিও শাস্ত্রে সুস্পষ্ট কিছু বলেনি তথাপি পাপের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে ঈশ্বর কোন ভাবেই দায়ী নন; কারণ সেখানে স্বর্গীয় অনুগ্রহ স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়নি, স্বর্গীয় প্রশাসনের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল না, যা বিদ্রোহী হয়ে ওঠার মত পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে । পাপ হল এক অনধিকার প্রবেশকারী যার উপস্থিতির জন্য কোন কারণ দর্শানাে যায় না । পাপ রহস্যময়, দুবােধ একে নিষ্কৃতি দেয়া মানে একে সমর্থন করা। এর পক্ষে কোন অজুহাত খুঁজে পেলে অথবা এর অস্তিত্বের কারণ দেখাতে পারলে এটি আর পাপ থাকছে না। আমাদের কাছে পাপের সংজ্ঞা একমাত্র ঈশ্বরের বাক্যে দেয়া আছে; তা হল “আত্তা লঙ্ঘনই পাপ;” এটি হল মহান নীতি “প্রেম” যা স্বর্গীয় প্রশাসনের ভিত্তি, আর পাপ হল তারই বিরুদ্ধে নীতি বহির্ভূত যুদ্ধ । GrHBen 15.3
মন্দের আবির্ভাবের পূর্বে, সমগ্র মহা বিশ্বে শান্তি এবং আনন্দ বিরাজিত ছিল । সব কিছুই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের সাথে নিখুঁত ভাবে ঐক্যে ছিল । ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা ছিল সর্বোচ্চ, পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ছিল নিরপেক্ষ । খ্রীষ্ট, যিনি বাক্য, ঈশ্বরের একাত স্বর্গীয় পিতার সাথে তিনি ছিলেন, স্বভাবে, চরিত্রে এবং অভিপ্রায় তারা এক ছিলেন। সমগ্র বিশ্বে তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ঈশ্বরের যাবতীয় পরামর্শের এবং উদ্দেশ্যের অংশী হতে পারতেন । খ্রীষ্টের দ্বারা ঈশ্বর স্বর্গের সমস্ত প্রাণীকুলকে সৃষ্টি করেছেন । “স্বর্গে ও পৃথিবীতে, দৃশ্য কি অদৃশ্য যে কিছু আছে, সিংহাসন হউক, কি প্রভুত্ব হউক, কি আধিপত্য হউক, কি কর্তৃত্ব হউক, সকলই তাহার দ্বারা ও তাহার নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছে” (কলসীয় ১:১৬); এবং পিতার সঙ্গে সমভাবে সমস্ত স্বর্গ খ্রীষ্টকে আনুগত্য প্রদান করে । GrHBen 16.1
যেহেতু ঈশ্বরের শাসন প্রণালীর ভিত্তি প্রেম, তাই তাঁর ধার্মিকতার মহা মূলনীতির সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয়ের ওপর সমস্ত সৃষ্ট প্রাণীদের সুখ নির্ভরশীল। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট সমস্ত প্রাণীকুলের কাছ থেকে প্রেমের সেবা প্রত্যাশা করেন--শ্রদ্ধা ভক্তি প্রত্যাশা করেন, যার মাধ্যমে ঈশ্বরের চরিত্রের স্বজ্ঞান নিঃসৃত প্রশংসা প্রস্রবনের মত স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হবে । জবরদস্তি করে আনুগত্যে তাঁর কোন আনন্দ নেই, তাই তিনি সবাইকে ইচ্ছা স্বাধীনতা দিয়েছেন, যেন তারা স্বেচ্ছায় তাঁর সেবা করে । GrHBen 16.2
কিন্তু একজন ছিল যে এই স্বাধীনতাকে ভুল পথে পরিচালিত করার সুযােগ নেয়। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে পাপও শুরু হয়, স্বর্গীয় পদমর্যাদায় যাকে ঈশ্বর খ্রীষ্টের পরেই সর্বোচ্চ সম্মান ও গৌরব প্রদান করেছিলেন । পতনের পূর্বে, লুসিফর ছিল আচ্ছাদক করূবদের মধ্যে প্রধান, পবিত্র এবং অকলুষিত। “প্রভু সদাপ্রভু এই কথা কহেন, তুমি পরিমাণের মুদ্রাঙ্ক, তুমি পূর্ণজ্ঞান, তুমি সৌন্দয্যে সিদ্ধ; তুমি ঈশ্বরের উদ্যান এদনে ছিলে; সর্বপ্রকার বহুমূল্য প্রস্তর চুনি, পীতমণি, হীরক, বৈদূর্য্যমণি, গােমেদক, সূৰ্য্যকান্ত, নীলকান্ত হরিন্মণি ও মরকত এবং স্বর্ণ তােমার আচ্ছাদন ছিল,...তুমি অভিষিক্ত আচ্ছাদক করূব ছিলে, আমি তােমাকে স্থাপন করিয়াছিলাম, তুমি ঈশ্বরের পবিত্ৰ পৰ্বতে ছিলে; তুমি অগ্নিময় প্রস্তর সকলের মধ্যে গমনাগমন করিতে। তােমার সৃষ্টি দিন অবধি তুমি আপন আচারে সিদ্ধ ছিলে; শেষে তােমার মধ্যে অন্যায় পাওয়া গেল।” যিহিষ্কেল ২৮:১২-১৫। GrHBen 16.3
লুসিফর ঈশ্বরের আনুকূল্যে ধন্য হয়ে থাকতে পারত, তাঁর আদর্শপূর্ণ দূতবাহিনীর প্রিয় ও সম্মানিত হয়ে থাকতে পারত, তাঁর আদর্শপূর্ণ ক্ষমতাসমূহকে অন্যের আশীর্বাদে ও আপন স্রষ্টার মহিমায় প্রয়ােগ করতে পারত। কিন্তু ভাববাদী বলেন, “তােমার চিত্ত তােমার সৌন্দর্য্যে গর্বিত হইয়াছিল; তুমি নিজ দীপ্তি হেতু আপন জ্ঞান নষ্ট করিয়াছ।” (১৭ পদ)। একটু একটু করে লুসিফর আত্ম-প্রশংসাকে প্রশ্রয় দেবার ইচ্ছা পােষণ করতে থাকে। “তুমি আপনার চিত্তকে ঈশ্বরের চিত্তের তুল্য বলিয়া মানিয়াছ ।” “তুমি মনে মনে বলিয়াছিলে,...ঈশ্বরের নক্ষত্রগণের ঊর্ধ্বে আমার সিংহাসন উন্নত করিব; সমাগম-পৰ্বতে, উত্তরদিকের প্রান্তে, উপবিষ্ট হইব; আমি মেঘরূপ উচ্চস্থলীর উপরে উঠিব, আমি পরাৎপরের তুল্য হইব।” যিহিষ্কেল ২৮:৬; যিশাইয় ১৪:১৩, ১৪। সৃষ্ট প্রাণীদের কাছে সখ্যতায় ও আনুগত্যে ঈশ্বরকে সর্বোচ্চ স্থান দেবার প্রচেষ্টার পরিবর্তে লুসিফর তাদের (সৃষ্ট প্রাণীদের সেবা ও ভক্তিকে নিজের অনুকূলে আনার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে। যে রাজকীয় বিশেষ ক্ষমতা পরম পিতা তাঁর একমাত্র প্রিয় পুত্র খ্রীষ্টকে দিয়েছেন তাঁর প্রতি সম্মান না দেখিয়ে ঊষা-নন্দন সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য উচ্চাকাঙ্খায় তাড়িত হয়েছিল । GrHBen 16.4
সমগ্র স্বর্গ, সৃষ্টিকর্তার মহিমা প্রকাশ ও গুণকীর্তন প্রদর্শন করতে উল্লাসিত হয়েছিল। আর এভাবে ঈশ্বরের সম্মাণিত হওয়ার কারণে সর্বত্র শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করছিল। আর তখন এক বিকৃত সুর সব স্বর্গীয় সুরকে বিকৃত করেছিল । যাদের মনে এ যাবৎ ঈশ্বরের মহিমা ছিল সর্বোচ্চ, তাদের মনে ঈশ্বরের পরিকল্পনার প্রতিকূল আত্ম-সেবা ও আত্ম-প্রশংসা ও মন্দতাজনিত অমঙ্গলের সূচনা উকি দিল । স্বর্গীয় পরিষদ লুসিফরকে বােঝাতে চেষ্টা করলেন । ঈশ্বরের পুত্র তাঁর কাছে ঈশ্বরের মহানতা, সদাশয়তা এবং ন্যায়পরায়নতা এবং তাঁর ব্যবস্থার পবিত্রতা ও অপরিবর্তনীয়তার প্রকৃতি তুলে ধরলেন । ঈশ্বর নিজে স্বর্গের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন, তা থেকে বিচ্যুত হয়ে লুসিফর তাঁর স্রষ্টাকে অসম্মান করবে এবং নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে । আর সে অসীম প্রেম ও করুণায় দেয়া সেই সতর্কবাণী প্রতিরােধের মনােভাব জাগায় । লুসিফর খ্রীষ্টের প্রতি তাঁর ঈর্ষাকে প্রাধান্য দিল এবং নিজ সংকল্পে অটল থাকল । GrHBen 17.1
তাঁর নিজের খ্যাতির অহঙ্কার শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্খায় পুষ্টি যােগাল । তাঁর ওপরে অর্পিত উচ্চ সম্মানকে লুসিফর ঈশ্বরের দান বলে স্বীকার করল না এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা দেখাল না । সে তাঁর ঔজ্জ্বল্যে ও পদমর্যাদায় গর্ববােধ করল এবং ঈশ্বরের সমতুল্য হবার উচ্চাকাঙ্খ করল । সে স্বর্গীয় বাহিনীর প্রিয়পাত্র ছিল। স্বর্গীয় দূতগণ তাঁর আজ্ঞা পালন করে আনন্দ পেত, আর জ্ঞানে ও গৌরবে সে তাদের সকলের সেরা ছিল । তথাপি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন স্বর্গের স্বীকৃত শাসনকর্তা, যিনি পরাক্রম ও ক্ষমতায় পিতার সমতুল্য। ঈশ্বরের সমস্ত মন্ত্রণা সভায় খ্রীষ্ট ছিলেন একজন অংশগ্রহণকারী অথচ লুসিফর স্বর্গীয় অভিপ্রায় সমূহের অংশীদার ছিল না । “কেন” পরাক্রমী এই দূত প্রশ্ন করল, “কেন খ্রীষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব” ভােগ করবেন? কেনই বা তিনি লুসিফরকে ছাড়িয়ে সম্মান পাবেন?” GrHBen 17.2
ঈশ্বরের উপস্থিতিতে লুসিফর তাঁর স্থানটি ছেড়ে দূতগণের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে দেবার জন্য লুসিফর চলে গেল । অত্যন্ত গােপনীয়তা রক্ষা করে আপাত ঈশ্বর ভত্তর অন্তরালে বেশ কিছুকাল আপন অভিপ্রায় লুকিয়ে রেখে, স্বর্গীয় প্রজাদের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিরক্তি ভস্কিয়ে দেবার প্রচেষ্টায় নিয়ােজিত রইল কারণ সে সকলের দ্বারা এক অনাবশ্যক বাধার সম্মুখীন হয়েছে বলে ইঙ্গিত করে। যেহেতু তাদের প্রকৃতি সৎ, তাই সে দূতগণকে অনুরােধ করে তারা যেন তাদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। ঈশ্বর খ্রীষ্টের ওপরে সর্বোচ্চ সম্মান অর্পন করে তাঁর সঙ্গে অন্যায্য ব্যবহার করেছেন বলে বর্ণনা করে সে সকলের কাছ থেকে নিজের পক্ষে সহানুভূতি গড়ার চেষ্টা করে। সে এই দাবি জাহির করে যে অধিকতর ক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার উন্নয়নের জন্য নয় কিন্তু তা সমস্ত স্বর্গ নিবাসীদের স্বাধীনতা পাবার জন্য, যেন এর মাধ্যমে তারা উচ্চতর অস্তিত্বের মর্যাদা পেতে পারে । GrHBen 17.3
নিজ করুণার গুণে ঈশ্বর লুসিফরতে দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করেছেন । প্রথম যখন সে তাঁর অসন্তোষ মনােভাব পােষণ করে, সেই কারণে তৎক্ষণাৎ তাকে তাঁর উচচ পদমর্যাদা থেকে অপসারণ করা হয়নি। এমন কি অনুগত দূতগণের কাছে তাঁর অসাধু দাবি উপস্থাপন করার পরেও তা করা হয়নি । দীর্ঘদিন যাবৎ তাকে স্বর্গে বহাল রাখা হয়েছে। অনুতাপ ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তাকে বার বার ক্ষমা ভিক্ষার আহবান জানানাে হয়েছে। একমাত্র অসীম প্রেম ও প্রজ্ঞা দ্বারাই এই ধরণের প্রচেষ্টা উদ্ভাবন করা সম্ভব । যার মাধ্যমে তাকে তাঁর ভুল বােঝাবার চেষ্টা করা হয় । স্বর্গে পূর্বে কখনো অসন্তোষের মনােভাব সম্পর্কে জানা ছিল না। প্রথমে লুসিফর নিজেও বুঝতে পারেনি সে কোথায় বিতাড়িত হতে চলেছে; তাঁর উপলব্ধির (অনুভূতির) যথার্থ প্রকৃতি সে নিজেও বুঝতে পারেনি। কিন্তু তাঁর অসন্তোষ যুক্তিহীন প্রমাণিত হলে সিফর মেনে নেয় যে তাঁর পথ অন্যায্য ছিল, আর ঐশ্বরিক দাবি ন্যায্য ছিল আর সেই কারণে তাঁর উচিতহ ছিল পূর্বে স্বর্গে যেমন ছিল সেই অবস্থাকে মেনে নেয়া । তা যদি সে করত, তাহলে সে নিজেকে ও অনেক দূতগণকে বাঁচাতে পারত। এই সময় তখনও সে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দেয়নি। যদিও সে আচ্ছাদক করাবের পদ পরিত্যাগ করেছে, তথাপি সে যদি সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞাকে স্বীকৃতি দিয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসতে ইচছুক হতাে এবং ঈশ্বরের মহা পরিকল্পনার অন্তর্গত তাঁর নিযুক্ত পদের মর্যাদা পূরণ করত, তাহলে তাকে তাঁর পদে পুনর্বহাল করা যেত। কিন্তু অহঙ্কার তাকে আত্মসমর্পণ করতে বারণ করল । জেদের সঙ্গে সে তাঁর আচরণ সমর্থন করতে থাকে, তাঁর যুক্তি হল তাঁর পক্ষে অনুতাপের কোন প্রয়ােজন নেই আর তাই সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর স্রষ্টার বিরুদ্ধে মহা সংঘর্ষে লিপ্ত করে । GrHBen 18.1
তাঁর সুনিপুণ বুদ্ধিমত্তার যাবতীয় কল-কুশলতা এখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সঙ্গে প্রতারণার কার্যে নিয়ােজিত হয়, যেন তাঁর অনুসারী দূতগণের সহানুভূতি অর্জন করতে পারে । খ্রীষ্টের দ্বারা তাকে সতর্ক করা ও বােঝানাে সত্ত্বেও সে তাঁর দুর্ণীতিপরায়ণতা দ্বারা বিশ্বাসঘাতী অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে থাকে। স্নেহের বন্ধনে যারা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ ছিল, তাদের কাছে। শয়তান বর্ণনা করে যে তাঁর সঙ্গে অন্যায় বিচার করা হয়েছে তাঁর পদমর্যাদার প্রতি সম্মান দেখানাে হয়নি, এবং তাঁর স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। খ্রীষ্টের বক্তব্যের ভুল বর্ণনা দিয়ে সে সত্যের অপলাপের মাধ্যমে সরাসরি মিথ্যার আশ্রয় নেয়, স্বর্গীয় নিবাসীদের সামনে তাকে অপদস্থ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন বলে সে ঈশ্বরের পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে। সে তাঁর এবং অনুগত দূতগণের মাঝে এক মিথ্যা বিবাদের সমস্যা দাঁড় করানাের প্রয়াস পায়। যাদের সে কলুষিত করতে এবং সম্পূর্ণভাবে তাঁর দলে আনতে পারেনি, তাদের সে স্বর্গীয় প্রাণীদের স্বার্থ সম্বন্ধে উদাসীন বলে অভিযুক্ত করে । ঠিক যে কর্মে সে নিজে লিপ্ত, ঈশ্বরের প্রতি যারা বিশ্বস্ত, তাদের বিরুদ্ধে সে ঠিক সেই কাজের অভিযােগ আনে । আর ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অভিযােগের সমর্থনে সে সৃষ্টিকর্তার বাক্য ও কার্যকে ত্রুটিপূর্ণ ও ভুলভাবে বর্ণনা করার পথ বেছে নেয় । ঈশ্বরের অভিপ্রায়সমূহ সম্বন্ধে চতুর তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করে দূতগণকে হতবুদ্ধি করা ছিল তাঁর একটি কৌশল । সাধারণ বিষয়গুলােকে সে রহস্যে আবৃত করে দেয় এবং সদাপ্রভুর সরলতম মন্ত ব্যসমূহকে কৌশলে বিকৃত করে তাঁর সম্বন্ধে সংশয় গড়ে তােলে । উন্নত পদমর্যাদা, স্বর্গীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তাঁর মূল উপস্থাপনাকে শক্তিশালী করেছিল, ফলে অনেকেই তাঁর সঙ্গে একত্রিত হয়ে স্বর্গীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। GrHBen 18.2
যতক্ষণ না অসন্তোষের মনােভাব প্রত্যক্ষ বিদ্রোহে পরিপক্ক না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈশ্বর শয়তানকে তাঁর কাজ চালিয়ে যাবার সুযােগ দেন । শয়তানের পরিকল্পনাসমূহের প্রকৃত স্বরূপ এবং প্রবণতা যাতে প্রকাশ পায় এবং সকলে যেন দেখতে পায় সেজন্য এর প্রয়ােজন ছিল। অভিষিক্ত করূব হিসেবে লুসিফর অত্যধিক পরিমাণে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিল, স্বর্গীয় প্রাণীগণ দ্বারা সে অত্যধিক প্রীতির পাত্র ছিল এবং তাদের ওপরে তাঁর প্রবল প্রভাব ছিল । ঈশ্বরের রাজ্য কেবল স্বর্গের নিবাসীগণকেই অন্তর্ভুক্ত করে না বরং তা নিখিল বিশ্বের অন্যান্য সকল বিশ্বকে অন্তর্ভুক্ত করে যা তিনি সৃষ্টি করেছেন, আর শয়তান ভেবেছিল যে, যদি সে স্বর্গের দূতগণকে বিদ্রোহে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে তাহলে সে অন্যান্য বিশ্বকেও তাঁর অধিকারে আনতে পারবে । তাঁর অভিষ্ট বস্তু পাবার লক্ষ্যে চতুরতার সাথে কুতর্ক ও প্রতারণা প্রয়ােগ করে সে তাঁর পক্ষে যুক্তি পেশ করে। তাঁর প্রতারণা করার ক্ষমতা খুবই প্রবল ছিল, আর এক মিথ্যার খােলসে নিজেকে আড়াল করে সে কিছুটা প্রাধান্যতা অর্জন করে। এমন কি অনুগত দূতগণও সম্পূর্ণভাবে তাঁর চরিত্র বুঝাতে পারেন নি বা জানাতে পারেন নি যে তাঁর কর্মকাণ্ডের পরিণতি কি । GrHBen 19.1
শয়তান এত অধিক সম্মানিত ছিল এবং তাঁর কাজগুলাে রহস্য দ্বারা এত আবৃত ছিল যে দূতগণের পক্ষে তাঁর কাজের স্বরূপ উঘাটন করা। কষ্টসাধ্য ছিল। সম্পূর্ণরূপে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত পাপের মন্দতার স্বরূপ পরিলক্ষিত হবে না । ঈশ্বরের নিখিল বিশ্বে এ পর্যন্ত এর কোন অস্তিত্ব ছিল না এবং পবিত্র প্রাণীপণের এর প্রকৃতি এবং এর মারাত্মক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না। ঐশ্বরিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করার যে কি ভয় কর। পরিণতি হয় তা তারা বুঝতে পারেনি। শুরুতে শয়তান তাঁর কাজ কর্মকে ঈশ্বর-ভক্তির আপাত সত্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। সে ঈশ্বরের মর্যাদা উন্নত করতে তাঁর শাসনের স্থায়িত্ব বর্ধিত করতে এবং স্বর্গের সমস্ত নিবাসীদের মঙ্গল করতে ইচ্ছুক বলে দাবি করে। তাঁর অধীন দূতগণের মাঝে অসন্তোষ ছড়াতে থাকা সত্ত্বেও চাতুর্যের সাথে সে এটি দেখায় যে, সে আসলে অসন্তোষ অপসারণ করার চেষ্টা করছে। সে যখন ঈশ্বরের শাসনতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ ও ব্যবস্থা সম্বন্ধীয় পরিবর্তনের সনির্বন্ধ অনুরােধ করে তখন সে এই যুক্তি দেখায় যে স্বর্গের ঐক্য বজায় রাখার জন্য এটি প্রয়ােজন। GrHBen 20.1
পাপের সঙ্গে মােকাবেলায় ঈশ্বর কেবল ধার্মিকতা এবং সত্য প্রয়ােগ করতে পারতেন । ছল-চাতুরী এবং প্রতারণা যা কেবল শয়তান ব্যবহার করতে পারে, ঈশ্বর তা পারেন না। সে ঈশ্বরের কথনকে মিথ্যা প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিল এবং দূতগণের সম্মুখে তাঁর স্বর্গীয় প্রশাসনের পরিকল্পনাগুলোকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করল, সে এই বলে দোষারােপ করল যে স্বর্গীয়। নিবাসীদের ওপর আইন-কানুন জারী ন্যায়সঙ্গত নয়; তিনি আবশ্যিকভাবে তাঁর নিজের সৃষ্ট প্রাণীদের কাছ থেকে বশ্যতা ও বাধ্যতা আবশ্যিক তিনি শুধু আপন মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চেয়েছেন। যাতে সমগ্র স্বর্গনিসী তথা সমগ্র বিশ্বের কাছে এটা প্রমাণিত হয় যে ঈশ্বরের শাসনপ্রণালী ন্যায়সঙ্গত এবং তাঁর ব্যবস্থা সিদ্ধ । শয়তান এরূপ প্রকাশ্যে জাহির করেছিল যে, সে একমাত্র নিজেই বিশ্বের মঙ্গল ও উন্নতি সাধন করতে চেয়েছে। শয়তানের প্রতিটি জবর দখলকারী প্রকৃতির চরিত্র এবং তাঁর অভিপ্রায় সকলের অবশ্যই অবগত হওয়া প্রয়ােজন। নিজ পুর্মের মাধ্যমে তাঁর স্বরূপ প্রকাশিত হতে নিশ্চিত ভাবে সময়ের প্রয়ােজন। GrHBen 20.2
নিজের কর্ম পদ্ধতির জন্যে স্বর্গে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাঁর জন্য শয়তান ঈশ্বরের ব্যবস্থা ও শাসন প্রণালীকে দায়ী করল। সকল মন্দের কারণ ঈশ্বরের প্রশাসন বলে সে ঘােষণা দিল । সদাপ্রভুর বিধি ব্যবস্থার উন্নতি সাধনই ছিল তাঁর স্বীয় অভিপ্রায় বলে সে দাবি করল । এজন্য তাঁর দাবিগুলাের প্রকৃতি স্পষ্টরূপে প্রদর্শিত হবার এবং ঐশ্বরিক ব্যবস্থায় তাঁর প্রস্ত বিত পরিবর্তনগুলাের উদ্দেশ্য প্রদর্শন করার প্রয়ােজন ছিল। তাঁর নিজের কর্মই যেন তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। প্রথম থেকেই শয়তান দাবি করে। এসেছে যে সে বিদ্রোহে নামেনি। সমগ্র বিশ্ব দেখুক তাঁর মুখােসের অন্তরালে আসল রূপ। GrHBen 20.3
যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে তাঁর পক্ষে স্বর্গে থাকা সম্ভব নয়, এমন কি অসীম জ্ঞানের অধিকারী (ঈশ্বর) শয়তানকে ধ্বংস করেননি। যেহেতু ঈশ্বরের কাছে কেবলমাত্র প্রেমােদ্ভুত সেবাই গ্রহণযােগ্য, তাই সৃষ্ট প্রাণীদের আনুগত্যের ভিত্তি হতে হবে তাঁর ন্যায়পরায়নতায় ও বদান্যতায় দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর । স্বর্গের ও অন্যান্য পৃথিবীর অধিবাসীগণ পাপের প্রকৃতি ও পরিণাম হৃদয়ঙ্গম করতে অনুপযুক্ত ছিল বলে, শয়তানের বিনাশের পেছনে ঈশ্বরের ন্যায় বিচার ও করুণা বুঝতে তখন তারা সক্ষম ছিল না। তৎক্ষণাৎ তাঁর অস্তিত্ব মুছে দিলে প্রেমের বদলে ভয়ে তারা ঈশ্বরের সেবা করত । প্রতারকের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হত না, বিদ্রোহের মনােভাবও একেবারে নির্মূল হত না। মন্দকে অবশ্যই পরিপক্ব হতে সুযােগ দেয়া প্রয়ােজন । শয়তান পূর্ণভাবে তাঁর নীতিসমূহের বিকাশ সাধন করুক, যেন সকল সৃষ্ট প্রাণীর পক্ষে ঈশ্বরের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযােগগুলাের যথার্থতা কতটুকু তা বিবেচনা করা সম্ভব হয়, যেন ঈশ্বরের ন্যায় বিচার ও করুণা এবং তাঁর ব্যবস্থার অপরিবর্তনশীলতা চিরতরে প্রশ্নাতীত বলে প্রতিষ্ঠিত হয় । GrHBen 21.1
আগামী দিনের সর্বযুগে শয়তানের বিদ্রোহ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা চিরকাল পাপের প্রকৃতি ও ভয়াবহতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য বহন করবে। ঈশ্বরের প্রভুত্ব ও আধিপত্য অপসারণ করার পরিণাম যে কি হতে পারে, মানুষের ও দূতগণের ওপরে শয়তানের শাসনের কর্মধারা ও তাঁর প্রভাবই তা দেখিয়ে দেবে । এটা এই সাক্ষ্য বহন করবে যে, ঈশ্বরের শাসনপ্রণালী ও তাঁর বিধি ব্যবস্থার অস্তিত্বের সঙ্গেই নিহিত রয়েছে তাঁর দ্বারা সৃষ্ট সকল প্রাণীর মঙ্গল । এরূপে বিদ্রোহের ভয়ঙ্কর পরীক্ষ-নিরীক্ষার ইতিহাস সমস্ত পবিত্র বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণীদের জন্যে চিরকালের এক রক্ষা কবচ হয়ে থাকবে, যা তাদের আজ্ঞালঙ্ঘনের প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রতারিত হওয়া থেকে বিরত রাখবে, যেন পাপ কার্যে লিপ্ত হওয়া থেকে এবং তাঁর জন্য শাস্তি ভােগ করা থেকে বাচে। GrHBen 21.2
স্বর্গে সংঘাতের শেষ সময় পর্যন্ত মহা জবর-দখলকারী নিজের কর্ম পন্থার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে রত থাকবে। যখন তাঁর সমস্ত অনুসারীদের সঙ্গে তাকে স্বর্গীয় সুখকর আবাস থেকে অবশ্যই তাড়িয়ে দেয়া হবে বলে ঘােষণা করা হলাে, তখন বিদ্রোহী নেতা উদ্ধতভাবে স্রষ্টার ব্যবস্থার প্রতি প্রকাশ্যে তাঁর ঘৃণা প্রকাশ করল । সে বারংবার জোরালােভাবে বলল যে দূতগণের ওপরে কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজন নেই, নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী চলার স্বাধীনতা তাদের থাকা উচিত, যা তাদের সর্বদা সঠিক পথে পরিচালিত করবে । স্বর্গীয় প্রশাসন কর্তৃক অনুমােদিত বিধিবদ্ধ আইনকে তাদের স্বাধীনতার প্রতি একটা বাধা বলে বর্ণনা করে সে প্রকাশ্যে স্বর্গীয় প্রশাসনের নিন্দা করল, এবং ঘােষণা করল যে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হল। বিধিবদ্ধ আইনের বিলােপ সাধন নিশ্চিত করা; যা তাদেরকে এই বাধা থেকে মুক্ত করে স্বর্গীয় নিবাসীদের জন্য অধিক মর্যাদা এনে দেবে, অধিক গৌরবময় অস্তিত্ব এনে দেবে। GrHBen 21.3
শয়তান এবং তাঁর বাহিনী একত্রিত হয়ে তাদের বিদ্রোহের পেছনে কারণ হিসেবে সমস্ত দোষ খ্রীষ্টের ওপরে অর্পণ করে এবং এই বলে ঘােষণা দেয় যে তাদের যদি ভৎসনা না করা হতাে তাহলে তারা বিদ্রোহী হতাে না । আর তারা তাদের রাজদ্রোহে একগুয়ে ও উদ্ধত থাকে, ঈশ্বরের প্রশাসন ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করার বৃথা চেষ্টা করে, তথাপি তারা ঈশ্বরের নিন্দা করে নিজেদের অত্যাচারী শাসনের নির্দোষ বলিরূপে দেখাতে সচেষ্ট হয়, অবশেষে প্রধান বিদ্রোহী ও তাঁর প্রতি সহানুভূতিকারী সকলেই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়। GrHBen 22.1
যে মনােভাব স্বর্গে বিদ্রোহের প্রেরণা যুগিয়েছে, সেই একই মনােভাব আজও পৃথিবীতে বিদ্রোহে উৎসাহিত করে। দূতগণের ক্ষেত্রে যে নীতি শয়তান অনুসরণ করেছে সেই একই নীতি সে মানুষের জন্যেও অনুসরণ করে চলেছে । অবাধ্য সন্তানদের মধ্যে এখনও তারই আত্মা রাজত্ব করই। তারই মত তারাও ঈশ্বরের ব্যবস্থার আত্মসংযম ভেঙ্গে ফেলতে চায়, এবং তাঁর বিধিসকল লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবকে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়। পাপের ভৎসনাপূর্ণ অভিব্যক্তি আজও বিদ্বেষ ও প্রতিরােধের মনােভাব জাগায়। ঈশ্বরের সতর্কবার্তা যখন বিবেকে পৌঁছায়, শয়তান মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থনে এবং তাদের পাপকর্মের প্রতি অন্যের সহমর্মিতা খুঁজতে পরিচালিত করে। নিজেদের ভুল সংশােধনের পরিবর্তে, ভৎসনাকারীর বিরুদ্ধে তা ঘৃণা মিশ্রিত রােষ উৎপন্ন করে, যেন সে-ই মুশকিল ও অসুবিধার একমাত্র কারণ। যারা পাপকে নিন্দা করার সাহস করে তাদের প্রতি সেই ধার্মিক হেবলের সময় কাল থেকে আমাদের বর্তমান কাল পর্যন্ত এরূপ একই মনােভাব প্রদর্শন করা হয়ে থাকে । GrHBen 22.2
ঈশ্বরের চরিত্র ত্রুটিপূর্ণরূপে বর্ণনা করতে যে পদ্ধতি স্বর্গে অনুসরণ করেছিল সেই একইভাবে ঈশ্বরকে কঠোর ও স্বেচ্ছাচারীরূপে বিবেচনা করিয়ে শয়তান মানুষকে পাপে প্রবৃত্ত করে। আর এ পর্যন্ত সফল হয়ে সে ব্যক্ত করে যে ঈশ্বরের অন্যায্য বিধি নিষেধের ফলে মানুষ পতিত হয়েছে, যার কারণে সে নিজেও বিদ্রোহী মনােভাব দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল । GrHBen 22.3
কিন্তু অসীম অনন্ত যিনি, তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেন, “সদাপ্রভু, সদাপ্রভু, স্নেহশীল ও কৃপাময় ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর এবং দয়াতে ও সত্যে মহান; সহস্র সহস্র (পুরুষ) পর্যন্ত দয়ারক্ষক, অপরাধের, অধৰ্ম্মের এবং পাপের ক্ষমাকারী; তথাপি তিনি অবশ্য [পাপের] দণ্ড দেন; পুত্র পৌত্রদের উপরে, ততীয় ও চতুর্থ পুরুষ পৰ্যস্ত, তিনি পিতৃগণের অপরাধের প্রতিফল বৰ্ত্তান।” যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬,৭। GrHBen 22.4
স্বর্গ থেকে শয়তানের নির্বাসনে ঈশ্বর তাঁর ন্যায়বিচার ঘােষণা, করেন এবং তাঁর সিংহাসনের মর্যাদা বজায় রাখেন। কিন্তু এই ধর্মভ্রষ্ট আত্মার প্রতারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ যখন পাপে পতিত হল, তখন ঈশ্বর তাঁর প্রেমের প্রমাণ স্বরূপ তাঁর একমাত্র পুত্রকে পতিত মানব জাতির পক্ষে মৃত্যুবরণ করতে প্রেরণ করলেন। প্রায়শ্চিত্তকার্যে ঈশ্বরের চরিত্র প্রকাশিত হল । ক্রুশের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি সমগ্র বিশ্বের কাছে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, লুসিফর কর্তৃক বেছে নেয়া পাপের কার্যধারার জন্য ঈশ্বরের শাসন প্রণালীকে কোন ক্রমেই দোষী করা যায় না । GrHBen 23.1
ত্রাণকর্তার পার্থিব সেবা কার্য কালের অন্তর্গত খ্রীষ্ট ও শয়তানের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মহা প্রতারকের মুখােশ খসে পড়ে। বিশ্ব পরিত্রাতার উপর শয়তানের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ফলে সমস্ত দূতগণের স্নেহ-মমতা থেকে এবং অনুগত সমগ্র নিখিল বিশ্বের কাছ থেকে সে যতটা কার্যকর ভাবে উৎপাটিত হয়েছে ততটা কার্যকর উৎপাটন আর কিছুই তাকে করতে পারত না। ঈশ্বর নিন্দার দুঃসাহসিকতার পেছনে তাঁর চাওয়া ছিল যেন, খ্রীষ্ট তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন, আর সে প্রবল দুঃসাহসিকতায় তাঁকে পর্বত শিখরে এবং ধর্মধামের চূড়ায় নিয়ে যায়, বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব নিয়ে সে তাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শিকারীর খোজে, সে যাজকদের ও সাধারণ জনতার হৃদয়ে তাঁর প্রেম প্রত্যাখ্যান করতে অনুপ্রাণীত করে, আর তারই শেষ চিৎকার ছিল, “উহাকে ক্রুশে দাও! উহাকে ক্রুশে দাও!”—এ সবই বিশ্বের উত্তেজনাপূর্ণ বিস্ময় ও ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধ । GrHBen 23.2
শয়তানই খ্রীষ্টকে প্রত্যাখান করার জন্য জগৎকে প্রবৃত্ত করেছে। যীশুকে ধ্বংস করতে মন্দতার নায়ক তাঁর সমস্ত শক্তি ও চাতুর্য প্রয়ােগ করছে, কারণ সে উপলব্ধি করে যে ত্রাণকর্তার করুণা ও প্রেম, তাঁর সহানুভূতি ও করুণাসুলভ কোমলতা জগতের সম্মুখে ঈশ্বরের চরিত্র ব্যক্ত করছিল । ঈশ্বরের পুত্র দ্বারা পেশ করা প্রত্যেকটি দাবির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে সে তাঁর দ্বন্দ্বপূর্ণ মােকাবিলা করতে মানুষকে তাঁর প্রতিনিধিরূপে নিয়ােগ করেছে যেন তারা পরিত্রাণকর্তার জীবন দুঃখ ও কষ্টে পরিপূর্ণ করে তােলে। যে চাতুর্য ও মিথ্যার দ্বারা সে যীশুর কাজের বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছে, অবাধ্যতার সন্তানদের দ্বারা যে শত্রুতা প্রদর্শিত হয়েছে, অতুলনীয় উৎকর্ষে ভরা সেই জীবন যাপনকারীর বিরুদ্ধে এগুলাে ছিল তারই নিষ্ঠুর সব অভিযােগ যার সবটাই তাঁর বদ্ধমূল প্রতিহিংসা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। জমে থাকা ঘৃণা ও বিদ্বেষ, শত্রুতা ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা, ঈশ্বরের পুত্রের বিরুদ্ধে তা কালভেরীতে ফেটে পড়ে, যে দৃশ্য সমগ্র স্বর্গ নীরব ভয়ে বিহব্বলতায় অবলােকন করে । GrHBen 23.3
মহা আত্মত্যাগ সুসম্পন্ন হলে খ্রীষ্ট স্বর্গে আরােহণ করেন আর তিনি দূতগণের ভক্তি প্রশংসা এই বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন ঃ “পিত: আমার ইচ্ছা এই, আমি যেখানে থাকি, তুমি আমায় যাহাদিগকে দিয়াছ, তাহারাও যেন সেখানে আমার সঙ্গে থাকে।” যােহন ১৭:২৪। আর তখন অবর্ণনীয় প্রেম ও শক্তিসহ পিতার সিংহাসন থেকে এই উত্তর আসে ? “ঈশ্বরের সকল দূত ইহার ভজনা করুক।” ইব্রীয় ১:৬। যীশুর ওপর কোন কলঙ্ক আর অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর অবমাননার সমাপ্তিতে তাঁর আত্মত্যাগের পূর্ণতা প্রাপ্তিতে তাকে সবার সেরা এক নাম প্রদান করা হল । GrHBen 24.1
এই সময় ক্ষমার অযােগ্য রূপে শয়তানের অপরাধ প্রকাশ পায় । এক মিথ্যাবাদী ও খুনীরূপে সে আপন চরিত্রকে প্রকাশ করে দেয় । এটা স্পষ্ট হয় যে, তাঁর নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকা মনুষ্য সন্তানদের প্রতি যে মনােভাব নিয়ে সে কর্তৃত্ব করেছে, সুযােগ পেলে একইভাবে স্বর্গনিবাসীদের ক্ষেত্রেও সে একই মনােভাব প্রকাশ করত। সে দাবি করেছিল যে ঈশ্বরের ব্যবস্থা লক্ষ্যন স্বাধীনতা ও উন্নতি আনবে কিন্তু তাঁর ফল দাঁড়াল দাসত্ব ও অবনমন । GrHBen 24.2
ঈশ্বরের চরিত্র ও শাসনের বিরুদ্ধে শয়তানের মিথ্যা অভিযােগের প্রকৃত রূপ বেরিয়ে পড়ে। সে ঈশ্বরকে এই মর্মে দোষারােপ করেছে যে তাঁর প্রাণীগণের বশ্যতা ও আনুগত্য দাবি করার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজ মর্যাদা বৃদ্ধি, এবং সে আরও বিবৃতি দিয়েছে যে, অপর সকলের আত্মত্যাগ দাবি করলেও তিনি নিজেকে কোন আত্মত্যাগ স্বীকার করেননি। এক্ষেত্রে। বাস্তবে দেখা গেল যে একটি ভ্রষ্ট ও পাপী জাতির পরিত্রাণের জন্য বিশ্বের শাসনকর্তার যে মহা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা একমায় ভালবাসার কারণেই সম্ভব হয়; কারণ “ঈশ্বর খ্রীষ্টে আপনার সহিত জগতের সম্মিলন করাইয়া দিতেছিলেন।” ২ করিন্থীয় ৫:১৯। এতে এটিও প্রকাশ পেল যে, লুসিফর যেখানে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের অভিলাষে পাপ প্রবেশের রাস্তা উন্মুক্ত করেছে, সেখানে খ্রীষ্ট পাপ বিনষ্ট করতে নিজেকে অবনত করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত অনুগত থাকেন। GrHBen 24.3
বিদ্রোহ নীতির প্রতি ঈশ্বর তাঁর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন । শয়তানকে দোষারােপ ও মানবের পরিত্রাণ এই উভয় ক্ষেত্রেই সমগ্র স্বর্গ ঈশ্বরের ন্যায় বিচার দেখতে পেল। শয়তান এই বলে বিবৃতি দিয়েছে যে, ঈশ্বরের ব্যবস্থা যদি অপরিবর্তনীয় হয় এবং এর শাস্তি যদি মওকুফ না হয়, তাহলে প্রত্যেক আজ্ঞা লঙ্ঘনকারীকে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হতে হবে। সে দাবি করে যে পাপী জাতি পরিত্রাণের নাগালের বাইরে থাকায়, তাঁর ন্যায্য শিকারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টের মৃত্যু মানবের পক্ষে এমন এক যুক্তি যা খণ্ডন করা যায় না। ব্যবস্থার শাস্তি এমন একজনের ওপর গিয়ে পড়ল যিনি ছিলেন ঈশ্বরের সমতুল্য, আর মানুষ খ্রীষ্টের ধার্মিকতা গ্রহণে ও একটি প্রায়শ্চিত্ত ও বিনম্র জীবন গ্রহণের মাধ্যমে শয়তানের সমস্ত শক্তির ওপর বিজয় অর্জন করেছে। অতএব ঈশ্বর। ন্যায়পরায়ণ তথাপি যারা যীশুতে বিশ্বাস করে তাদের প্রতিও তিনি তদ্রপ । GrHBen 24.4
তবে কেবল মানবের পরিত্রাণ সাধনকল্পেই খ্রীষ্ট পৃথিবীতে এসে দুঃখভােগ ও মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি ব্যবস্থাকে মহৎ করতে” এবং “এটি সমাদরণীয়” করতেও এসেছিলেন। ব্যবস্থা যেরূপ সমাদরণীয় এই জগতের নিবাসীগণ যেন সেভাবে ব্যবস্থাকে সমাদর করে শুধু তাই নয় নিখিল বিশ্বের সকল পৃথিবীর কাছে, যেন এটি প্রমাণিত হয় যে ঈশ্বরের ব্যবস্থা অপরিবর্তনীয়। ব্যবস্থার দাবিগুলাে যদি উপেক্ষা করা যেত তাহলে এর লঙ্ঘন জনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ঈশ্বরের পুত্রকে তাঁর জীবন উৎসর্গ করতে হত না । খ্রীষ্টের মৃত্যুই এর অপরিবর্তনশীলতা প্রমাণ করে। আর পাপীরা যেন মুক্তি পায়, তাঁর জন্য অসীম প্রেম পিতা ও পুত্রকে যে বলিদান করতে চালিত করেছে যা প্রায়শ্চিত্তের পরিকল্পনা ব্যতীত অন্য কিছুর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না- যা সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে ন্যায় বিচার ও অনুগ্রহ হচ্ছে ঈশ্বরের ব্যবস্থা ও শাসন প্রণালীর ভিত্তি । GrHBen 25.1
শেষ বিচারকার্য শেষে এটি স্পষ্ট হবে যে পাপের কোন কারণ আর অবশিষ্ট নেই। যখন সমগ্র নিখিল বিশ্বের বিচারকর্তা শয়তানের কাছে কৈফিয়ত চাইবে, “আমার বিরুদ্ধে তুমি কেন বিদ্রোহী হয়েছ এবং কেন তুমি আমাকে আমার রাজ্যের প্রজাগণ থেকে বঞ্চিত করেছ?” পাপের উদ্ভাবকের পক্ষে কারণ দর্শানাের কোন উপায় থাকবে না। প্রতিটি কণ্ঠ রুদ্ধ হবে সমগ্র বিদ্রোহী বাহিনী নির্বাক হয়ে যাবে । GrHBen 25.2
কালভেরীর ক্রুশ, যখন ব্যবস্থার অপরিবর্তনশীলতা ঘােষণা করে, সেই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে এও ঘােষণা করে যে পাপের বেতন মৃত্যু। “সমাপ্ত হইল” বলে ত্রাণকর্তার মৃত্যুকালীন ঘােষণার মধ্য দিয়ে শয়তানের মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। এতুর্দিন যাবৎ যে মহা সংঘর্ষ চলে আসছিল সেই মহা সংঘর্ষের ফলাফল তখনই নির্ধারিত হয়ে গেল, মন্দের চূড়ান্ত মূলােৎপাটন নিশ্চিত হয়ে গেল । ঈশ্বরের পুত্র কবরের দ্বার অতিক্রম করে যান, “যেন মৃত্যু দ্বারা মৃত্যুর কৰ্ত্তবিশিষ্ট ব্যক্তিকে অর্থাৎ দিয়াবলকে শক্তিস্থান করেন।” ইব্রীয় ২:১৪ । লুসিফরের আত্মােন্নতি সাধনের লিপ্সা তাকে বলতে উৎসাহিত করে, “ঈশ্বরের নক্ষত্রগণের উর্দ্ধে আমার সিংহাসন উন্নত করিব;...আমি পরাৎপরের তুল্য হইব।” ঈশ্বর ঘােষণা করলেন: “আমি তােমাকে দর্শনকারী সকলের সাক্ষাতে ভস্ম করিয়া ভূমিতে ফেলিয়া দিলাম।...এবং তুমি কোন কালে আর হইবে না।” যিশাইয় ১৪:১৩,১৪; যিহিকল ২৮:১৮,১৯। আর “সেই দিন আসিতেছে, তাহা হাপরের ন্যায় জ্বলিবে, এবং দর্পী ও দুষ্টাচারীরা সকলে খড়ের ন্যায় হইবে; আর সেই যে দিন আসিতেছে, তাহা তাহাদিগকে পােড়াইয়া দিবে, ইহা বাহিনীগণের সদাপ্রভু কহেন; সে দিন তাহাদের মূল কি শাখা কিছুই অবশিষ্ট রাখিবে না ।” মালাখি ৪:১। GrHBen 25.3
সমগ্র নিখিল বিশ্ব পাপের প্রকৃতি ও পরিমাণ সম্বন্ধে সাক্ষ্য বহন করবে। আর পাপের সম্পূর্ণ ধ্বংস, যা পূর্বে হয়ত দূতগণের মধ্যে ভীতি ও ঈশ্বরের প্রতি অশ্রদ্ধা আনয়ন করত, এক্ষণে তা তাঁর ভালবাসার সমর্থন করবে, এবং বিশ্বের সেই সব প্রাণীদের সম্মুখে তাঁর সম্মান প্রতিষ্ঠা করবে, যারা তাঁর ইচ্ছা সাধনে প্রীত ও যাদের অন্তরে তাঁর ব্যবস্থা বিদ্যমান। মন্দের আবির্ভাব আর কখনও হবে না । ঈশ্বরের বাক্য বলে: “দ্বিতীয় বার সঙ্কট উপস্থিত হইবে না।” নহ্ম ১:৯। ঈশ্বরের ব্যবস্থা, দাসত্বের বন্ধন বলে শয়তান যাকে অখ্যাতি করেছে তা স্বাধীনতার ব্যবস্থা বলে মহিমান্বিত হবে । একটি পরীক্ষিত ও প্রমাণিত বিশ্ব, যাদের কাছে তাঁর অগাধ ভালবাসা এবং অসীম জ্ঞান প্রকাশিত হয়েছে তারা কোন দিন আর তাঁর আনুগত্যতা থেকে মুখ ফেরাবে না । GrHBen 26.1
*****