পরম ধন্য আশা

6/19

৪ - ধর্ম-ভ্রষ্টতা

থিষলনীয়কীদের প্রতি তাঁর দ্বিতীয় পত্রে, প্রেরিত পৌল, পােপীয় শক্তিস্থাপনের ফলশ্রুতিতে যে মহা ধর্ম-ভ্রষ্টতা দেখা দেবে, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী করেন । তিনি ঘােষণা করেন যে, খ্রীষ্টের দিন আসার পূর্বে “সেই ধর্ম-ভ্রষ্টতা উপস্থিত হইবে, এবং সেই পাপ পুরুষ, সেই বিনাশ-সন্তান, প্রকাশ পাইবে, যে প্রতিরােধী হইলে ও ‘ঈশ্বর’ নামে আখ্যাত বা পূজ্য সকলের হইতে আপনাকে বড় করিবে, এমন কি, ঈশ্বরের মন্দিরে বসিয়া আপনাকে ঈশ্বর বলিয়া দেখাইবে ।” প্রেরিত তাঁর ভ্রাতৃগণকে সতর্ক করে দেন যে, “অধর্মের নিগুঢ়তত্ত্ব এখনই কার্যসাধন করিতেছে” (২ থিষলনীকীয় ২:৩, ৪)। এমন কি, সেই প্রারম্ভিক সেই সব ভুল ভ্রান্তি করছে, যা পােপত্বের পথ প্রস্তুত করবে। GrHBen 39.1

একটু একটু করে, প্রথমে গােপনে এবং চুপিসারে, শক্তিতে বৃদ্ধি। পেয়ে প্রকাশ্য মানুষের মনের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে “অধর্মের নিগূঢ়তত্ত্ব” তাঁর ভ্রান্তিজনক ঈশ্বর নিন্দার কাজে এগিয়ে গেছে। প্রায় ইন্দ্রিয়ের অগােচরে পৌত্তলিক রীতি-নীতি খ্রীষ্টান মণ্ডলীতে স্থান করে নিয়েছে । ভয়ানক তাড়নার দ্বারা কিছুকালের জন্যে আপােস ও বশ্যতা স্বীকারের মনােভাব সংযত ছিল । কিন্তু তাড়না বন্ধ হলে, খ্রীষ্ট-ধর্ম রাজগণের দরবারে প্রবেশ করলে, সে খ্রীষ্টের এবং তাঁর প্রেরিতদের নম্রতা পরিত্যাগ করে পৌত্তলিক পুরােহিত ও শাসকদেরও উদ্ধত ধারণ করে, এবং ঈশ্বরের দাবি-দাওয়ার স্থানে সে মানবীয় মতবাদ ও পরম্পরাগত বিধি স্থাপন করে। চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, কনস্টানটিনের নামমাত্র ধর্মান্তর মহা উল্লাসের কারণ ঘটায়; আর জগৎ সংসার ধার্মিকতার মুখােশধারী হয়ে মণ্ডলীর মধ্যে প্রবেশ করে। এক্ষণে ধর্মভ্রষ্টতার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পৌত্তলিকতা পরাজিত মনে হলেও জয়ে পরিণত হল । তাঁর আত্মা মণ্ডলী নিয়ন্ত্রণ করল । তাঁর ধর্ম বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান, ও কুসংস্কার স্বীকৃত খ্রীষ্টের অনুসারীদের ধর্ম বিশ্বাস ও উপাসনায় পরিণত হল । GrHBen 39.2

পৌত্তলিকতা ও খ্রীষ্টধর্মের বিশ্বাসের এই আপােসের পরিণামে সেই “পাপ পুরুষের বিকাশ ঘটে যে নিজেকে ঈশ্বরের বিরােধীতা ও ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে উন্নীত করবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল । ভ্রান্ত ধর্মেও সেই প্রকান্ড নিয়মবদ্ধ পদ্ধতি শয়তানের শক্তির এক শ্রেষ্ট অবদান নিজে সিংহাসন অধিষ্ঠিত করে তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুসারে জগৎ সংসারে শাসন করবার এক স্মৃতিস্তম্ভ বিশেষ । GrHBen 39.3

একলা শয়তান খ্রষ্টের সঙ্গে আপােস করবার চেষ্টা করেছিল । প্রান্ত রে প্রলােভনের মাধ্যমে সে ঈশ-পুত্রের কাছে এসে বিশ্বের রাজ্যসমূহের খ্যাত প্রতাপ দেখিয়ে, অন্ধকারের রাজপুত্রকে স্বীকৃতি জানাবার বদৌলতে এ সকল তাঁর কাছে সমর্পণ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল । খ্রীষ্ট ঐ দুঃসাহসী প্রলােভনকারীকে তিরস্কার করে ঐ স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন । তবে ঐ একই প্রলােভন মানুষের কাছে এনে শয়তান অধিকতর সাফল্য অর্জনের মুখ দেখে। পার্থিব লাভ ও মর্যাদা লাভ করতে, মণ্ডলী জগতের ক্ষমতাপন্ন, মহান ব্যক্তিদের সমর্থন লাভে পরিচালিত হয়; এবং এভাবে খ্রীষ্টকে অস্বীকার করে, সে শয়তানের প্রতিনিধি রােমীয় ধর্ম্যাংকের (পােপের) বশ্যতা স্বীকার করতে প্রবৃত্ত হয় । GrHBen 40.1

রােমায় ধর্মতন্ত্রের এক মূখ্য মতবাদ এই যে, পােপ হচ্ছে দৃশ্যমান সার্বজনীন খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর কর্মপ্রধান, যার ওপর জগতের সব স্থানের ধর্মযাজক ও পালকদের ওপরে সর্বোচ্চ ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, পােপকে একেবারে ঈশ্বরের উপাধি প্রদান করা হয়েছে। তাকে “প্রভু ঈশ্বর পােপ” বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে, এবং অভ্রান্ত বলে ঘােষণা করা হয়েছে । সে সকল লােকের শ্রদ্ধা ও সমাদর দাবি করে। প্রান্তরে শয়তান কর্তৃক পেশ করা একইরূপ দাবী রােমীয় মণ্ডলীর দ্বার প্রান্তে এখনাে তাঁর দ্বারা পেশ করা হচ্ছে, এবং বহু সংখ্যক লােক তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে প্রস্তুত। GrHBen 40.2

কিন্তু যারা ঈশ্বরকে ভয় করে ও শ্রদ্ধা করে, তারা ধূর্ত শত্রুর মােকাবিলা করেন যেমন খ্রীষ্ট করেছিলেন: “তােমার ঈশ্বর প্রভুকেই প্রণাম করিবে, কেবল তাঁহারই আরাধনা করিবে” (লুক ৪:৮)। ঈশ্বর তাঁর বাক্যে কখনাে এই ইঙ্গিত দেননি যে তিনি মণ্ডলীর মস্তক-রূপে কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছেন। পােপীয় শ্রেষ্ঠত্ত্ব সরাসরি শাস্ত্রের শিক্ষার বিপরীত। অন্যায় ভাবে অধিকার ছাড়া খ্রীষ্টের মণ্ডলীর ওপরে পােপের কোন ক্ষমতা থাকতে পারে না। GrHBen 40.3

রােমীয় ধর্মানুরাগীরা প্রটেস্ট্যান্টদের ওপরে ধর্ম বিরােধীতা ও সত্য মণ্ডলী থেকে একগুয়েমী কার পৃথক হয়ে যাবার অভিযােগ আনে। তবে এসব অভিযােগ বরং তাদের ওপরেই প্রযােজ্য। তারাই সেই দল যারা খ্রীষ্টের পতাকা পরিত্যাগ এবং “পবিত্রগণের কাছে একবার সমর্পিত বিশ্বাস” থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। (যিহুদা ৩)। GrHBen 40.4

শয়তান ভাল করেই জানত যে, পবিত্র শাস্ত্র লােকদেরকে তাঁর প্রতারণা সকল বুঝাতে ও তাঁর ক্ষমতা প্রতিহত করতে সক্ষম করবে। এই বাক্যের দ্বারাই জগতের ত্রাণকর্তা তাঁর আক্রমণ প্রতিরােধ করেছেন। প্রতিটি আক্রমণে খ্রীষ্ট অনন্ত সত্যের ঢাল উপস্থাপন করেছেন এবং বলেছেন, “লেখা আছে” । বিপক্ষের প্রতিটি প্রস্তাবে তিনি বাক্যের বিজ্ঞতা ও শক্তি দ্বারা প্রতিরােধ করেছেন । শয়তান মনুষ্যের ওপরে তাঁর কর্তৃত্ব অটুট রাখতে এবং পােপীয় অন্যায় অধিকারের প্রভাব স্থাপন করতে, তাদেরকে তাঁর শাস্ত্র সম্বন্ধে অজ্ঞ রাখতে হবে । বাইবেল ঈশ্বরকে মর্যাদা দান করবে এবং সসীম মানবদেরকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করবে; এ কারণ এর পবিত্র সত্য প্রত্যেককে অবশ্যই গােপন রাখতে হবে । এই যুক্তি রােমীয় মণ্ডলী দ্বারা অবলম্বন করা হয় । শত শত বছর যাবৎ বাইবেলের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তা অধ্যয়ন করতে ও তাদের ঘরে রাখতে নিষিদ্ধ করা হয়, নীতি জ্ঞানহীন যাজক ও পুরােহিতগণ তাদের অসত্য দাবি বজায় রাখতে তাঁর ব্যাখ্যা করেছে। এরূপে পােপ পৃথিবীতে প্রায় সার্বজনীনভাবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে, মণ্ডলী ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা তাঁর ওপর অর্পণ করা হয় । GrHBen 40.5

ভুল-নির্দেশক যন্ত্র সরিয়ে নেয়ায় শয়তান তাঁর ইচ্ছানুরূপে কাজ করেছে। ভাববাণী বলেছে যে, পােপত্ব “নিরূপিত সময়ের ও ব্যবস্থার পরিবর্তন করিতে মনস্থ করিবে” (দানিয়েল ৭:২৫)। এই কাজের প্রচেষ্টার গতি মধুর ছিল না। পুতুল পূজকদের মধ্য থেকে ধর্মান্তরিত করবার প্রচেষ্টায় মূর্তিপূজার এক বিকল্প হিসাবে, আর এরূপে তাদেরকে নামমাত্র খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে, খ্রীষ্টিয় উপাসনায় ধীরে ধীরে প্রতিমা ও স্মারক বস্তুর আরাধনা প্রবর্তন করা হয়। অবশেষে এক সাধারণ মন্ত্রণা সভার বিধান এই পৌত্তলিক প্রথার প্রচলন করা হয়। এই ঈশ্বর অসম্মানকারী কাজ সম্পূর্ণ করতে রােম ঈশ্বরের ব্যবস্থা থেকে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধকারী দ্বিতীয় আজ্ঞাটি মুছে ফেলবার পায়তারা দেখায় এবং দশম আওটি বিভক্ত করে সংখ্যা ঠিকই রাখে । GrHBen 41.1

পৌত্তলিকতার স্বীকৃতির মনােভাব স্বর্গের কর্তৃত্বের অধিক অবজ্ঞার একটি পথ উন্মুক্ত করে। শয়তান মণ্ডলীর অনুৎসর্গীকৃত নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে কাজ করে চতুর্থ আজ্ঞায় অন্যায় হস্তক্ষেপ করে এবং যে দিনকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করেছেন ও পবিত্র করেছেন (আদিপুস্তক ২:২, ৩, সেই আদি শাব্বাথ (বিশ্রামবার) অর্জন করবার চেষ্টা করে এবং এতদস্থানে পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা পালিত “সূর্যের পূজার দিনের মর্যাদায় সেই দিনটি স্থাপন করে। এই পরিবর্তনের উদ্যম প্রথমে খোলাখুলিভাবে নেয়া হয়নি । প্রথম শতাব্দিগুলােতে সকল খ্রীষ্টানই প্রকৃত শাব্বাথ (বিশ্রামবার) পালন করেছিল । তারা ঈশ্বর সমাদরে ঈর্ষাথিত ছিল, এবং তারা বিশ্বাস করেছিল যে, তাঁর ব্যবস্থা অপরিবর্তণশীল, তাঁরা ব্যবস্থার পবিত্রতা রক্ষা করেছিল । কিন্তু শয়তান মহাচাতুর্য সহকারে তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করণার্থে তাঁর প্রতিনিধিদের নিয়ে কাজ করল । লােকদের মনােযােগ যাতে রােববারের প্রতি আকর্ষিত হয়, তজ্জন্য সে খ্রীষ্টের পুনরুত্থানের সম্মানার্থে এক উৎসবের আয়ােজন করল । এখানে ধর্মীয় সভার অনুষ্ঠান করা হত, কিন্তু এদিনটিকে পুনরুত্থান দিন বলেই মান্য করা হত, তারপরেও শাব্বাথ দিনকে পবিত্র দিন বলে মান্য করা হত। GrHBen 41.2

যে কাজ করার জন্য শয়তান পরিকল্পনা করেছিল, তাঁর পথ প্রস্তুত করার জন্য, সে খ্রীষ্টের আগমনের পূর্বে যিহূদীদেরকে পরিচালিত করেছিল । অত্যন্ত কঠোর দাবী দাওয়া দিয়ে শাব্বাথ পালনকে বােঝাস্বরূপ করে তােলে। এখন, মিথ্যা জ্যোতির সুযােগ নিয়ে, এমন ভাবে সে এটি পালন করার পথ সুগম করল; সে ইহাকে এক যিহূদী ধর্ম প্রণালীরূপে তাঁর ওপর অবমাননা ছুড়ে মারল । যখন খ্রীষ্টানগণ সাধারণভাবে রবিবার দিনটি এক আনন্দের উৎসবরূপে পালন করতে থাকে, সে তাদেরকে যিহুদীধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণা প্রদর্শনার্থে, শাব্বাথ দিনকে এক উপবাসের, এক দুঃখ ও বিষাদের দিনরূপে পরিণত করতে তাদেরকে পরিচালিত করে। GrHBen 42.1

চতুর্থ শতাব্দির প্রথম ভাগে সম্রাট কনস্টানটাইন এক অধ্যাদেশ জারী করে, রােববারকে রােম সাম্রাজ্যব্যাপী এক সাধারণ উৎসবে পরিণত করে। তাঁর পৌত্তলিক প্রজাগণ কর্তৃক সূর্যের দিনটি সমাদৃত হল এবং, খ্রীষ্টানগণ কর্তৃক শ্রদ্ধা লাভ করল; এটি ছিল বিপরীতধর্মী পৌত্তলিকতা এবং খ্রীষ্টধর্মের মধ্যে ঐক্য গড়ে তােলার নাতি। সে মণ্ডলীর বিশপদের অনুরােধে এ কাজটি করে, যিনি উচ্চাকাঙ্খ ক্ষমতা লিপ্সায় অনুপ্রাণিত হয়ে উপলব্ধি করল যে, যদি খ্রীষ্টান ও পৌত্তলিকেরা একইদিন পালন করে, তা হলে। পৌত্তলিকদের নামমাত্র খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহিত করবে এবং এভাবে মণ্ডলী পরাক্রম ও মহিমায় বৃদ্ধি পাবে । কিন্তু যখন বহুসংখ্যক ঈশ্বর ভয়শীল খ্রীষ্টান ক্রমেই রােববারকে পবিত্রতার এক ঘােষণা বিবেচনা করে তা গ্রহণ করে, তবুও তারা সদাপ্রভুর পবিত্র দিনরূপে প্রকৃত শাব্বথ বলে ধরে রাখে। এবং চতুর্থ আজ্ঞার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। GrHBen 42.2

প্রধান প্রতারকের কাজ তখনাে শেষ হয়নি। সে খ্রীষ্টান বিশ্বকে তাঁর পতাকা তলে একত্রিত করতে দৃঢ় সংকল্প হল এবং তাঁর প্রতিনিধি, গর্বিত পাদ্রীদের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করল যিনি খ্রীষ্টের প্রতিনিধি বলে দাবি করেছিল। অর্ধ-ধর্মান্তরিত পৌত্তলিক, উচ্চাকাঙ্খী যাজক এবং জগৎ সংসার প্রিয় মণ্ডলীর লোেকদের মাধ্যমে সে তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করল । মাঝে মধ্যে বিশাল মন্ত্রণা সভার আয়ােজন করা হত, যেখানে বিশ্বের সর্বস্থান থেকে মণ্ডলীর উচ্চপদস্থ লােকবৃন্দ একত্রিত হতেন। প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণা সভায় ঈশ্বর প্রতিষ্ঠিত শাব্বাথকে একটু একটু করে অবনমিত করা হত, এভাবে রােববারকে উচ্চে তুলে ধরা হত। এভাবে, অবশেষে পৌত্তলিক উৎসবটি একটি ঐশ্বরিক অনুষ্ঠান বলে সমাদৃত হয়; একই সময়ে বাইবেল ভিত্তিক (বিশ্রামদিন) যিহূদী ধর্মের অবশিষ্টাংশ বা স্মারক বলে ঘােষিত হয় ও ইহার পালনকারিগণকে ঘৃণ্য বা অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করে । GrHBen 42.3

মহা ভট্টাচারী নিজেকে, “ঈশ্বর নামে আখ্যাত বা পূজ্য সকলের চেয়ে আপনাকে বড় করিয়া দেখাইবে” (২ থিষলনীকীয় ২:৪) করতে সক্ষম। হয় । সে একমাত্র ঐশ্বরিক ব্যবস্থার একমাত্র আজ্ঞা পরিবর্তন করতে স্পর্ধা করে, যা নির্ভুলভাবে সমগ্র মানব গােষ্ঠিকে সত্য এবং জীবন্ত ঈশ্বরকে নির্দেশ করে। চতুর্থ আজ্ঞায়, ঈশ্বর স্বর্গ ও মর্তের সৃষ্টিকর্তারূপে প্রকাশিত ও অন্যান্য দেব-দেবী থেকে ভিন্ন। এটি ছিল সব সৃষ্টিকাজের একটি স্মারক যে, সপ্তম দিন মানুষের জন্য একটি বিশ্রাম দিন। এ দিনটি এভাবে পরিকল্পিত ছিল যে, সৃষ্টিকর্তাকে তাদের জীবন্ত ঈশ্বর, জীবনের উৎস, তাদের উপাস্য ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে গেথে রাখার জন্য তাদের মনে স্থান দেয়। শয়তান প্রাণপণ চেষ্টা করে যেন সে মানুষকে ঈশ্বরের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং তাঁর ব্যবস্থার প্রতি আজ্ঞাবহতা থেকে তাদেরকে দূরে নিয়ে যেতে পারে; তাই সে বিশেষ করে ঐ আজ্ঞার বিরূদ্ধে তাঁর প্রচেষ্টা চালিয়ে নিচ্ছে যা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে নির্দেশ করে। GrHBen 43.1

প্রটেস্ট্যান্টগণ এখন সবিনয় নিবেদন করছে যে, রােববারে খ্রীষ্টের পুনরুত্থান দিনটিকে খ্রীষ্টান শাব্বাথ করেছে। কিন্তু শাস্ত্রে প্রমাণের অভাব রয়েছে । খ্রীষ্ট অথবা তাঁর প্রেরিতগণ কর্তৃক দিনটি সমাদৃত করা হয়নি । একটি খ্রীষ্টান নিয়ম-প্রণালীরূপে রােববার পালন “অধর্মের নিগূঢ়তত্ত্বের মধ্যে (২ থিষলনীকীয় ২:৭) সৃষ্ট, যা এমনকি পৌলের দিনে তাঁর কার্য আরম্ভ করেছিল। প্রভু কোথায় এবং কখন পােপত্বের এই সন্তানকে দত্তক নিয়েছেন? একটি পরিবর্তনের কোন বৈধ কারণ দেয়া যেতে পারে যা শাস্ত্র অনুমােদন করে না? GrHBen 43.2

ষষ্ঠ শতাব্দিতে পােপতন্ত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর ক্ষমতার আসন স্থাপিত হয় সাম্রজ্যবাদী নগরে; এবং রােমের বিশপকে গােটা মণ্ডলীর ওপরে প্রধানরূপে ঘােষণা দেয়া হয়। পৌত্তলিকতা পােপত্বের মধ্যে স্থান। পেল। নাগ পশুকে আপনার পরাক্রমে ও আপনার সিংহাসন ও মহৎ কর্তৃত্ব তাহাকে দান করিল” (প্রকাশিত ১৩:২)। আর এখন আরম্ভ হয় ১২৬০ বছর ব্যাপী পােপীয় অত্যাচার যা দানিয়েল এবং প্রকাশিত বাক্যে ভবিষদ্বাণী করা হয়েছিল । দানিয়েল ৭:২৫; প্রকাশিত বাক্য ১৩:৫-৭ । খ্রীষ্টানদের বাধ্য করা হয়েছিল, তাদের বিশ্বস্ততা পরিহার করে পােপীয় অনুষ্ঠানাদি পালন এবং ভজনা করা, অন্যথায় অন্ধকার কারাগারে তাদের জীবন নাশ করা অথবা। শারীরিক উৎপীড়ন দানকারী যন্ত্র, জ্বলন্ত কাঠি, কুঠারাঘাত ইত্যাদির মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করা । এখন যীশুর বাণী পূর্ণ হল; “তােমরা পিতামাতা, ভ্রাতৃগণ, জ্ঞাতি ও বন্ধুগণ কর্তৃকও সমর্পিত হইবে, এবং তােমাদের কাহাকেও কাহাকেও তাহারা বধ করাইবে । আর আমার নাম প্রযুক্ত তােমরা সকলের ঘৃণিত হইবে (লূক ২১:১৬,১৭)। বিশ্বাসীগণের ওপরে অধিকতর প্রচণ্ড উৎপীড়ন আরম্ভ হয় যা অতীতে কখনাে দৃষ্ট হয়নি, ফলে জগৎ এক বিশাল যুদ্ধ ক্ষেত্রে রূপ নিল। শত শত বছর পর্যন্ত খ্রীষ্টের মণ্ডলী গােপনে ও নির্জনতায় আশ্রয় নিয়েছে । ভাববাদী এভাবে বলেছেন, “আর সেই স্ত্রী লােকটি প্রান্তরে পলায়ন করিল; তথায় এক সহস্র দুই শত ষাট দিন পর্যন্ত প্রতিপালিত হইবার জন্য ঈশ্বরকর্তৃক প্রস্তুত তাহার একটি স্থান আছে” (প্রকাশিত ১২:৬)। GrHBen 43.3

রােমীয় মণ্ডলী ক্ষমতায় আরােহণ করার পরপরই অন্ধকারময় যুগের সূচনা ঘটে। তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আরাে গাঢ় হয়। প্রকৃত ভিত্তি খ্রীষ্টের নিকট থেকে বিশ্বাস রােমের পােপের ওপরে স্থানান্তরিত হয় । ঈশ্ব-পুত্র নির্ভরশীল না হয়ে বরং পাপের ক্ষমা এবং অনন্ত পরিত্রাণের জন্য লােকেরা পােপ এবং পুরােহিতদের স্মরণাপন্ন হয় যাদের ওপর সে ক্ষমতা অর্পণ করেছে। তাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, পােপই তাদের পার্থিব মধ্যস্থ এবং তাঁর মাধ্যম বিহীন কেউই ঈশ্বরের কাছে পৌছতে পারে না; এবং ঈশ্বরের স্থানে সে দণ্ডায়মান হয়েছে এবং সন্দেহাতীতভাবে তারই আজ্ঞাবহ হতে হবে। অন্যথায় সে নিদারুণ মানসিক ও শারীরিক শাস্তি ভােগ করবে। লােকদের মন ঈশ্বর থেকে ভ্রান্ত, ত্রুটিপূর্ণ এবং নিষ্ঠুর মানব, নির্দয় লােকদের দিকে ফিরে গেল, কেবল তাই নয় স্বয়ং অন্ধকারের রাজকুমারের দিকে ফিরে গেল, যে তাদের মাধ্যমে ক্ষমতা ব্যবহার করল। পাপকে এক পবিত্রতার বসনে লুকানাে হল । শাস্ত্র যখন চাপা দিয়ে রাখা হয় এবং মানুষ। যখন নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে; তখন আমাদের কেবলমাত্র ছলনা, প্রতারণা, এবং হীন অপরাধই দেখে থাকি । মানব ব্যবস্থা এবং পরম্পরাগত বিধি উচ্চে তুলে ধরার সঙ্গে সেসব ভ্রষ্টতা পরিলক্ষিত হয় যা ঈশ্বরের ব্যবস্থাকে এক পার্শ্বে রেখে দেবার পরিণাম । GrHBen 44.1

খ্রীষ্ট মণ্ডলীর পক্ষে ঐ দিনগুলাে ছিল সংকটকাল । বিশ্বস্ত পতাকা। বহনকারীদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই অল্প। যদিওবা সত্য সাক্ষ্যবিহীন রয়ে যায়নি, তথাপি সময় এরূপ মনে হল যে ভ্রান্তি এবং কুসংস্কার সম্পূর্ণরূপে টিকে রইলাে এবং পৃথিবী থেকে প্রকৃত ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেল । সুসমাচার দৃষ্টি বহির্ভূত হয়, কিন্তু ধর্মের বাহ্যিক অবয়ব বৃদ্ধি পায় আর লােকেরা অত্যন্ত কঠোর দাবী-দাওয়া সমূহ দ্বারা ভারাক্লান্ত হয়ে পড়লাে। GrHBen 44.2

তাদের মধ্যস্থতারূপে কেবলমাত্র পােপের দিকে দৃষ্টিপাত করতে শিক্ষা দেয়া হয়নি, কিন্তু পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্যে তাদের নিজেদের কর্মের প্রতি নির্ভর করতেও শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। দীর্ঘ তীর্থ যাত্রা, প্রায়শ্চিত্ত সাধন, শ্রদ্ধা বা ভক্তির সংরক্ষিত স্মারক বস্তুর পূজা, গীর্জাঘর, মূর্তি, এবং বেদী নির্মাণ, মণ্ডলীতে মােটা অঙ্কের অর্থদান--ঈশ্বরের ক্রোধ শান্ত করার বা তাঁর অনুগ্রহ লাভার্থে অন্যান্য একই প্রকার কার্য যুক্ত হল, যেন ঈশ্বর মানুষেরই তুল্য, যা মামুলি ব্যাপারে রাগান্বিত করা যায়, কিংবা উপহার বা প্রায়শ্চিত্তের কাজ কর্ম দ্বারা সন্তুষ্ট করা যায় । GrHBen 45.1

ঐ লাম্পট্য থেকে যাওয়া সত্ত্বেও রােমীয় মণ্ডলীর নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ছিল তাঁর প্রভাব, ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি পেলাে । অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে, পােপবাদিগণ এই দাবী পেশ করে যে, মণ্ডলীর প্রথম যুগেও রােমের বিশপগণ একই আত্মিক অধিকারী হয়েছিল, যা তাদের এখন আছে বলে ধরে নেয়। এই দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অবশ্যই ক্ষমতার একটু বর্হিপ্রকাশ নিয়ােগ করতে হবে এবং এটি তাৎক্ষণিকভাবে মিথ্যাবাদীর পিতা কর্তৃক পরামর্শ প্রদান করা হল । ঋষিগণ (মঠবাসী সন্নাসীগণ) কর্তৃক প্রাচীনকালীন লেখনীগুলি জাল করা হলাে। প্রচীনকালীন অধ্যাদেশগুলাে আবিষ্কার করা হলাে যা প্রাচীন কাল থেকে পােপের সার্বজনীন প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে যা কোন দিন শােনা যায় নি। আর একটি মণ্ডলী যা সত্যকে অস্বীকার করেছিল, তা লােভের বশবর্তী হয়ে এসব প্রতারণা গ্রহণ করলাে। GrHBen 45.2

প্রকৃত ভিত্তির উপরে মুষ্টিমেয় বিশ্বস্ত নির্মাতাগণ (১ করিন্থীয় ৩:১০,১১) মিথ্যা ধর্মতত্ত্বের জঞ্জালরূপে কাভার বাধা সৃষ্টি করলে ঘাবড়ে গেলেন এবং বাধাপ্রাপ্ত হলেন । নহিমিয়ের সময়ে যিরূশালেমের প্রাচীর নির্মাতাগণের ন্যায় কোন কোন লােক একথা বলতে প্রস্তুত ছিল: “ভারবাহকেরা দুর্বল হইয়াছে এবং ধ্বংসাবশেষ অনেক আছে, প্রাচীর গাঁথা আমাদের অসাধ্য” (নহিমিয় ৪:১০)। চাতুর্য, অপরাধ এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি বাধ্য, যা শয়তান তাদের উন্নয়নের পথে আনয়ন করতে পারে, তাঁর বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম হেতু ক্লান্ত, এরই মধ্যে বিশ্বস্ত নির্মাতারা ভগ্নোদ্যম হয়ে পড়ল; এবং তাদের। সম্পদ এবং তাদের জীবনের শান্তি এবং নিরাপত্তার খাতিরে, তারা সত্য ভিত্তি থেকে পশ্চাৎপদ হলাে। অন্যান্যরা তাদের শত্রুগণের বিরােধ দ্বারা অকুতােভয়; তারা নির্ভয়ে ঘােষণা করলাে: “তােমরা উহাদের হইতে ভীত হইও না; মহান ও ভয়ঙ্কর প্রভুকে স্মরণ কর” (১৪ পদ); আর তারা তাদের কাজে অগ্রসর হল, প্রত্যেকে তাদের তরবারি এবং খড়গ হাতে পাহারা দিতে লাগল (ইফিষীয় ৬:১৭)। GrHBen 45.3

সত্যের প্রতি ঘৃণা এবং বিরােধীতার একই আত্মা প্রতিটি যুগে ঈশ্বরের শত্রুদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তাদের জাগ্রতাবহু এবং বিশ্বস্ততা তাঁর দাসগণের মধ্যে বিরাজ করা আবশ্যক ছিল । খ্রীষ্টের সর্বপ্রথম অনুগামীদের প্রতি কথিত বাক্য শেষকালে তাঁর শিষ্যদের প্রতি প্রযােজ্য; “আর আমি তােমাদিগকে যাহা বলিতেছি, তাহাই সকলকে বলি, জাগিয়া থাকিও” (মার্ক ১৩:৩৭)। GrHBen 46.1

অন্ধকার ক্রমেই গাঢ় হতে লাগল । মূর্তি পূজা আরাে সার্বজনীন হতে দেখা গেল । মূর্তির সামনে মােম বাতি জ্বালানাে হলাে, তাদের কাছে প্রার্থনা উৎসর্গ করা হল। অতীব অযৌক্তিক এবং কুসংস্কারজনক প্রথা অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠলাে। মানুষের মন ও চিন্তাধারা সমূহ সম্পূর্ণরূপে কুসংস্কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলাে যা মনে হলাে যে, সে তাঁর পথ হারিয়ে ফেলেছে। যখন পুরােহিত এবং বিশপগণ নিজেরা আমােদ-প্রিয়, কামাভিলাসী এবং ভ্রষ্ট হয়ে ওঠেছিল, তখন কেবলমাত্র এই প্রত্যাশাই করা হতাে যে লােকেরা পরিচালনার জন্য তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করত, তারা মুখতা এবং লাম্পট্যের মধ্যে ডুবে যেত । GrHBen 46.2

পােপীয় দাম্ভিকতায় আরাে একটি পদক্ষেপ নেয়া হল, যখন, একাদশ শতাব্দিতে পােপ গ্রেগরী ৭ম রােমীয় মণ্ডলীর শুদ্ধিকরণ ঘােষণা দিল। তিনি যে প্রস্তাবগুলাে রেখেছিলেন তাঁর মধ্যে একটিতে এই ঘােষণা করা হয়েছিল যে শাস্ত্রানুযায়ী মণ্ডলী কখনাে ভুল করেনি, আর সে কখনাে ভুল করবে না । কিন্তু শাস্ত্র থেকে এ উক্তির কোন প্রমাণ দেয় নি। গর্বিত পােপও সম্রাটদের পদচ্যুত করবার ক্ষমতা দাবী করেছিল এবং সে ঘােষণা করেছিল যে, সে যে কোন আদেশ ঘােষণা করলে, তা কোন ব্যক্তির দ্বারা হেরফের করা যাবে না; কিন্তু তাঁর বিশেষ অধিকার যে, সে অন্য সকলের সিদ্ধান্ত সমূহের পরিবর্তন করতে পারে । GrHBen 46.3

জার্মান সম্রাট হেনরীর (৪র্থ) সঙ্গে তাঁর আচরণ নির্ভুলতার এই প্রবক্তার অত্যাচারী স্বভাবের এক উপযুক্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় । পােপের ক্ষমতা অমান্য করার সাহস প্রদর্শন করায় এই সম্রাটকে মণ্ডলীর সমাজচ্যুত ও রাজ্যচত বলে ঘােষণা করা হয়। আপনার রাজন্যবর্গের তাঁর পক্ষ ত্যাগ এবং তাঁর নিজ অধ্যক্ষদের ধমকানিতে মৃত্যু ভয় দ্বারা ভীত সন্ত্রস্ত, যেহেতু পােপীয় রায় দ্বারা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উৎসাহিত করা হয়েছিল, রােমের সঙ্গে তাঁর শান্তি স্থাপনের আবশ্যকতা হেনরী উপলব্ধি করতে পারলেন। তাঁর স্ত্রী এবং একজন বিশ্বস্ত ভৃত্যকে সাথে নিয়ে শীতকালের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আল্পস পর্বত অতিক্রম করেন, যেন তিনি পােপের সম্মুখে নিজেকে অবনত করতে পারেন । দুর্গের কাছে পৌছে যেখানে গ্রেগরীর প্রস্থান করা সম্ভ্রান্ত আবাসে পৌঁছলে তাকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বহিঃপ্রাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়; আর সেখানে শীতে তীব্র ঠান্ডায় অনাবৃত মস্তকে এবং খালি পায়ে এবং শােচনীয় পােশাকে তিনি পােপের সম্মুখে আসার অনুমতি লাভের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি তিনদিন পর্যন্ত উপবাস ও অপরাধ স্বীকার করার পূর্বে পােপ তাকে ক্ষমা প্রদান করতে রাজী হননি। তাঁর পরেও এটি ছিল শর্তসাপেক্ষে যে, তাঁর পদমর্যাদার পূর্ণ গ্রহণ অথবা রাজকীয় ক্ষমতার ব্যবহার করবার পূর্বে তাকে পােপের অনুমােদন লাভের অপেক্ষা করতে হবে। আর গ্রেগরী আপনার বিজয়ে আনন্দিত হয়ে গর্ব করলেন যে, রাজার গর্ব খর্ব করাই ছিল তাঁর কর্তব্য। GrHBen 46.4

এই অহংকারী পােপের উদ্ধত ও একগুঁয়ে গর্ব এবং খ্রীষ্টের নম্রতা ও বিনয়ের মধ্যে কি-ই-না এক স্পষ্ট ব্যবধান; যিনি প্রবেশাধিকার লাভের জন্য হৃদয় দুয়ারে অনুমতি প্রার্থনা করছেন যেন ভিতরে প্রবেশ করে ক্ষমা এবং শান্তি আনয়ন করতে পারেন, যিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন । “তােমাদের মধ্যে যে কেহ প্রধান হইতে চায়, সে তােমাদের দাস হইবে” (মথি ২০:২৭)। GrHBen 47.1

পরবর্তী শতাব্দীগুলােতে রােম থেকে পেশ করা ধর্মীয় শিক্ষার এক বিরামহীন বৃদ্ধি লাভ পরিলক্ষিত হয়েছে। এমনকি পেপতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে GrHBen 47.2

পৌত্তলিক দার্শনিকদের শিক্ষামালার প্রতি মনােযােগ প্রদান করা হয়েছে এবং মণ্ডলীতে একটা প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। অনেকে যারা মন পরিবর্তনের ভান করেছিল তারা তখনাে তাদের পৌত্তলিক দর্শনের দিকে ঝুকেছিল, তারা কেবলমাত্র এগুলােই অধ্যায়ন করেনি, কিন্তু পৌত্তলিকদের মধ্যে তাদের প্রভাব ছড়িয়ে দেবার একটি মাধ্যমরূপে অন্যদেরকে সজোরে অনুরােধ জানিয়েছে। এরূপে খ্রীষ্টানদের বিশ্বাসের সঙ্গে মারাত্বক ভ্রান্তির পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় । এসবের মধ্যে মানুষের সহজাত অমরত্বে ও মৃত্যুতে তাঁর চেতনা ছিল উল্লেখযােগ্য। এই ধর্মবিশ্বাস যে ভিত্তি স্থাপন করে, তাঁর ওপরে রােম সাধুগণের আহ্বান ও কুমারী মরিয়মের উপাসনা প্রতিষ্ঠা করে। এ থেকে পরে পাপীদের অনন্ত যন্ত্রণা ধর্মমতের এক বিরুদ্ধমত উৎপন্ন হয়, যা ইতিমধ্যে পােপীয় বিশ্বাসে সংযুক্ত হয়েছিল । GrHBen 47.3

অতঃপর পৌত্তলিকতার আরেকটি আবিষ্কারের পথ প্রস্তুত হয়, রােম যাকে “পারগেটরী” অর্থাৎ “মৃত্যুর পরে আত্মার পাপ ক্ষালন” নামে আখ্যা দেয় এবং বিশ্বাসপ্রবণ ও অন্ধবিশ্বাসী জনসাধারণকে আতঙ্কিত করার চেষ্টা করে। এই ধর্মদ্রোহীতা দ্বারা এক অত্যাচারের স্থান স্বীকৃতি পায় যেখানে পাপের শাস্তি ভােগ করবে এবং সেস্থান থেকে অপবিত্রতা মুক্ত হয়ে তারা স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি লাভ করবে । GrHBen 48.1

তবু, তাঁর অনুগতদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য আরেকটি মিথ্যাচার উদ্ভাবনের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে--এ অর্থ যােগান দিয়েছিল “পাপের জন্য শাস্তিলাভ হতে অব্যহতি পাবার মতবাদ” (“doctrine of Indulgences) নামক শিক্ষা প্রবর্তন করে। তাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে, তারা সব রকমের পাপ ক্ষমা পাবে--পূর্বের, বর্তমানের, ও ভবিষ্যতের; সব রকমের ব্যথা-বেদনা ও শাস্তি থেকে তারা রেহাই পাবে যদি তারা পার্থিব্য রাজ্য সম্প্রসারণের নিমিত্ত পােপের সহিত যুদ্ধে শামিল হয়-- তাঁর শত্রুদের শাস্তি দিতে, যারা পােপের আধ্যাত্মিক আধিপত্যকে অস্বীকার করার জন্য সাহস পাচ্ছে, তাদের ধ্বংস করতে তারা যদি সহায়তা করে। লােকদের আরও শিক্ষা দেয়া হয়েছিল যে, অর্থ-কড়ি দিয়ে মণ্ডলীকে সাহায্য করলে তারা পাপ থেকে মুক্তি পাপে এবং তাদের মৃত আত্মিয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা যারা মুক্তি পাবে । এ উপায়ে রােম তাদের ধনভাণ্ডার পূর্ণ করে এবং তাঁর তথাকথিত প্রতিনিধি জাক- জমকপূর্ণ ও বিলাসিতায় ভােগ-বিলাস করে-যেখানে তাঁর (যীশুর) মাথা রাখার ঠাই মিলে নি । GrHBen 48.2

প্রভুর ভােজের প্রতিমা পূজা সম্বন্ধীয় বলি দ্বারা শাস্ত্র সম্মত প্রভুর ভােজের স্থান পূর্ণ করা হলাে। পােপীয় যাজকগণ সাধারণ রুটি ও দ্রাক্ষারসের পরিবর্তে তা তাদের অর্থহীন অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকৃত “খ্রীষ্টের শরীর ও রক্ত” হিসেবে পরিণত করার ভান করে । --(Cardinal Wiseman, The Real Presence of Body of Our Lord Jesus Christ in the Blessed Eucharist, Proved from Scripture, Lecture-8, Sec3, Part-26). ঈশ্বরের নিন্দাকারী ধৃষ্টতা দ্বারা, খােলামেলাভাবে ঈশ্বর নিন্দার সহিত দাবী করেছে যে, সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের মত তাদেরও সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে। খ্রীষ্টানদের মৃত্যু যন্ত্রণা-ভােগ করতে হবে, প্রকাশ্যে স্বর্গের নিন্দাকারী ধর্মদ্রোহীতার এই ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা ঘটাতে হয়েছে । অসম্মত হওয়া বহুসংখ্যক লােকদের অগ্নিতে সমর্পন করা GrHBen 48.3

ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে পােপ-তন্ত্রের ঐ অতীব ভয়াবহ উপায়সমূহ-- Inquisition, অর্থাৎ রােমান ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীদের অনুসন্ধান করে দমন করবার জন্য স্থাপিত বিচারালয় স্থাপন করা হয়। অন্ধকারের অধিনায়ক পােপবাদী যাজক গােষ্ঠীয় নেতাদের সঙ্গে কাজ করে । তাদের গােপন মন্ত্রণালয়ে শয়তান এবং তাঁর দূতগণ দুষ্ট লােকদের মন নিয়ন্ত্রণ করল, এই সময়ে ঈশ্বরের এক দূত অলক্ষ্যে দন্ডায়মান হয়ে, তাদের বিচারের দৃশ্যের ভয়াবহ আদেশ নথিভূক্ত করেন এবং এই অতীব ভীতিপূর্ণ দৃশ্য মানব দৃষ্টিগােচরে আনার জন্য লিখে রাখেন । “মহতী বাবিল, সাধুগণের রক্তে মত্ত ছিল । সাক্ষ্যমরদের লক্ষ লক্ষ খন্ড শরীর ধর্মদ্রোহীর শক্তির প্রতিশােধ নেবার জন্য ঈশ্বরের নিকট উচ্চস্বরে ক্রন্দন করে । GrHBen 49.1

পােপলু হলাে বিশ্বের অত্যাচারী শাসকগােষ্ঠী। রাজন্যবর্গ এবং সম্রাটগণ রােমীয় পােপের আদেশের নিকট শিরনত করলেন। মানুষের ভাগ্য তখন এবং অনন্তকালের জন্য যেন তারই (পােপের) নিয়ন্ত্রণাধীন। শত শত বছর পর্যন্ত লােকেরা ব্যাপকভাবে রােমের ধর্মতত্ত্বের ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানাদি ভক্তিভাবে পালন করা হয়েছে, সার্বজনীনভাবে উৎসবাদি পালন করা হয়ে আসছে। মণ্ডলীর ধর্মযাজকরা সমাদৃত হয়েছে ও উদারতার সঙ্গে সুবিধা লাভ করেছে। অতীতে রােমীয় মণ্ডলী কখনাে এত শ্রেষ্ঠতর মর্যাদা ও আড়ম্বরে বা ক্ষমতায় বৃদ্ধি লাভ করেনি। GrHBen 49.2

কিন্তু “পােপতন্ত্রের মধ্যাহ্ন ছিল বিশ্বের মধ্যরাত্রি” । --J. A. Wylie, The History of Protestantism, b.1, ch.4. পবিত্র শাস্ত্র-কলাপ ছিল প্রায়। অজানা, কেবলমাত্র লােকদের কাছে নয় কিন্তু যাজকদের কাছেও । পুরােনােকালে ফরীশীদের মত পােপীয় নেতাগণ তাদের পাপ প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে জ্যোতি ঘৃণা করেছিল। ধার্মিকতার মানদণ্ড, ঈশ্বরের ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে, তারা সীমাহীনভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করেছে, এবং লাম্পট্য বিরাজ করেছে । ছলনা, অতিরিক্ত ধনলিপ্সা, ও লাম্পট্য সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। মনুষ্য এমন কোন অপরাধ থেকে সরে আসেনি যার দ্বারা তাদের অর্থ উচ্চপদস্থ যাজকবর্গের প্রাসাদসমূহ ছিল জঘন্যতম লম্পটের দৃশ্যপট। কোন কোন শাসক মহাযাজকগণ এত জঘণ্য অপরাধে লিপ্ত ছিলেন যে, জাগতিক শাসক গােষ্ঠী মণ্ডলীর এই সকল উচ্চপদস্থ ব্যাক্তিদেরকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করেছে। বহু শতাব্দী ধরে ইউরােপে শিক্ষা, কলাকৌশল কিংবা সভ্যতায় কোন অগ্রগতি লাভ করেনি । খ্রীষ্টিয় সমাজের ওপরে এক নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত পক্ষাঘাতে পতিত হল । GrHBen 49.3

রােমীয় ক্ষমতাধীন বিশ্বের অবস্থা হােশেয় ভাববাদীর বাক্যের অত্যন্ত অভিভূতকারী পূর্ণতা পেশ করেছে: “জ্ঞানের অভাব প্রযুক্ত আমার প্রজাগণ বিনষ্ট হইতেছে; তুমি তাে জ্ঞান অগ্রাহ্য করিয়াছ, এই জন্য আমিও তোমাকে নিতান্ত অগ্রাহ্য করিলাম ।...তুমি আপন ঈশ্বরের ব্যবস্থা ভুলিয়া গিয়াছ, আমিও তােমার সন্তানগণকে ভুলিয়া যাইব।” “কারণ দেশে সত্য নাই, দয়া নাই, ঈশ্বরীয় জ্ঞানও নাই । শপথ, মিথ্যাবাক্য, নরহত্যা; চুরি ও ব্যাভিচার চলিতেছে, লােকেরা অত্যাচার করে, এবং রক্তপাতের উপরে রক্তপাত হয়” (হেশেয় ৪: ৬, ১, ২)। এরূপই ছিল ঈশ্বরের বাক্য দূরীভূত করার পরিণাম । GrHBen 50.1

*****