খ্রীষ্টের দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা

27/61

“ঈশ্বর কি আপনার সেই মনোনীতদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন না?”

লূক ১৮:১-৮ পদের উপর ভিত্তি করে রচিত

খ্রীষ্ট তাঁর দ্বিতীয় আগমনের ঠিক আগের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলছিলেন এবং তাঁর অনুসারীদেরকে যে সমস্ত দুর্দশা ও কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সেগুলো বলছিলেন। সেই সময়ের কাছে বিশেষ যোগসূত্র রেখে তিনি এই দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বলেছিলেন, “তাঁহাদের সর্বদাই প্রার্থনা করা উচিত, নিরুৎসাহ হওয়া উচিত নয়।” COLBen 145.1

“কোন নগরে এক বিচারকর্তা ছিল,” খ্রীষ্ট বললেন, “সে ঈশ্বরকে ভয় করিত না, মনুষ্যকেও মানিত না। আর সেই নগরে এক বিধবা ছিল, সে তাহার নিকটে আসিয়া বলিত, অন্যায়ের প্রতীকার করিয়া আমার বিপক্ষ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন! বিচারকর্তা কিছুকাল পর্যন্ত সম্মত হইল না; কিন্তু পরে মনে মনে কহিল, যদিও আমি ঈশ্বরকে ভয় করি না, মনুষ্যকেও মানি না, তথাপি এই বিধবা আমাকে ক্লেশ দিতেছে, এই জন্য অন্যায় হইতে ইহাকে উদ্ধার করিব, পাছে এ সর্বদা আসিয়া আমাকে জ্বালাতন করিয়া তুলে। পরে প্রভু কহিলেন, শুন, ঐ অধার্মিক বিচারকর্তা কি বলে। তবে ঈশ্বর কি আপনার সেই মনোনীতদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন না, যাহারা দিবারাত্র তাহার কাছে রোদন করে, যদিও তিনি তাঁহাদের বিষয়ে দীর্ঘসহিষ্ণু? আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, তিনি শীঘ্রই তাহাদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন।” COLBen 145.2

এখানে যে বিচারকর্তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তার ন্যায় অন্যায় নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না, বা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতিও তার কোন দয়া ছিল না। যে বিধবাটি তার কাছে বিচার চাইতে এসেছিল সে বার বার তার কাছে আসছিল। যে পর্যন্ত না বিচারকর্তা বিরক্ত হয়ে বিচার করতে সম্মত হল, সে পর্যন্ত সেই বিধবাটি বার বার তার আর্জি নিয়ে আসতেই থাকল। বিচারকর্তা জানতো যে, বিধবাটির দাবী ছিল ন্যায্য এবং সে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিচার নিষ্পত্তি করে দিতে পারত, কিন্তু সে তা করে নি। সে তার সর্বময় ক্ষমতা দেখাতে চেয়েছিল এবং বিধবাটি বার বার তার কাছে এসে বিচার চাওয়াতে সে বেশ সন্তুষ্টই হয়েছিল। কিন্তু বিধবা মহিলাটি বিচার চাইতে চাইতে নিরুৎসাহিত হয় নি কিংবা বিচার চাওয়া থামিয়েও দেয় নি। বিচারকর্তা যতই উদাসীন এবং কঠিন হৃদয়ের হোক না কেন, বিধবাটি তার বিচার নিয়ে বার বারই আসতে লাগল, যে পর্যন্ত না বিচারকর্তা এই বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে সম্মত হল। “যদিও আমি ঈশ্বরকে ভয় করি না, মনুষ্যকেও মানি না,” বিচারকর্তা মনে মনে বলল, “তথাপি এই বিধবা আমাকে ক্লেশ দিতেছে, এই জন্য অন্যায় হইতে ইহাকে উদ্ধার করিব, পাছে এ সর্বদা আসিয়া আমাকে জ্বালাতন করিয়া তুলে।” সে তার নিজের সম্মান রক্ষা করার জন্য, মানুষের চোখে তার একচোখা ও পক্ষপাতদুষ্টতার জন্য দোষীকৃত হওয়ার ভয়ে বিধবা মহিলাটির বিচার নিষ্পত্তি করতে রাজি হল। COLBen 145.3

“পরে প্রভু কহিলেন, শুন, ঐ অধার্মিক বিচারকর্তা কি বলে। তবে ঈশ্বর কি আপনার সেই মনোনীতদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন না, যাহারা দিবারাত্র তাহার কাছে রোদন করে, যদিও তিনি তাঁহাদের বিষয়ে দীর্ঘসহিষ্ণু? আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, তিনি শীঘ্রই তাহাদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন।” এখানে খ্রীষ্ট সেই অন্যায্য বিচারকর্তা ও ঈশ্বরের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য টেনেছেন। বিচারকর্তা কেবল তার ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার কারণে, অর্থাৎ বিধবা তার কাছে বার বার বিচার চেয়ে যে বিরক্তি সৃষ্টি করেছিল তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিচার করতে রাজি হয়েছিল। সে বিধবা মহিলাটির জন্য কোন ধরনের দয়া বা সহানুভূতির মনোভাব পোষণ করে নি; তার দুঃখ দুর্দশা বিচারকর্তার মনে কোন ভাবান্তর ঘটায় নি। যারা ঈশ্বরের অন্বেষণ করে তাদের প্রতি তাঁর আচরণ কত না বিপরীত, এই বিচারকর্তার আচরণের তুলনায়। যারা তাদের অভাব ও দুর্দশা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে আবেদন ও প্রার্থনা নিয়ে আসে, তাদের প্রতি তিনি অপরিমেয় দয়া ও করুণা বর্ষণ করেন। COLBen 146.1

বিচারকর্তার কাছে যে মহিলাটি এসেছিল তার স্বামী মারা গিয়েছিল। দরিদ্র ও নিঃসঙ্গ এই বিধবা মহিলার নিজ সম্পদ উদ্ধারের জন্য আর কোন সহায় ছিল না। একই ভাবে মানুষও পাপে পতিত হয়ে ঈশ্বরের সাথে তার সংযোগ হারিয়ে ফেলে। তার নিজে থেকে পরিত্রাণ লাভের কোন আশা থাকে না। কিন্তু খ্রীষ্টেতে আমরা পিতা ঈশ্বরের কাছে উপনীত হতে পারি। যাদেরকে ঈশ্বর তাঁর নিজের লোক হিসেবে মনোনীত করেন তারা তাঁর খুব প্রিয়। তাদেরকে তিনি অন্ধকারের অমানিশা থেকে তাঁর স্বর্গীয় আলোতে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা তাঁর গৌরব প্রশংসা করে, যেন তারা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে তাঁর আলো ছড়িয়ে দিতে পারে। বিচার চাইতে আসা বিধবার উপকার করার জন্য অধার্মিক বিচারকর্তার কোন বিশেষ আগ্রহ ছিল না; তথাপি সে বার বার বিধবার বিচার চাইতে আসার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তার আবেদনে সাড়া দিয়েছিল এবং বিধবা মহিলাটিকে তার বিপক্ষদের হাত থেকে মুক্ত করেছিল। কিন্তু তাঁর সন্তানদেরকে ঈশ্বর যে ভালবাসা দেন তার কোন সীমা নেই। তাঁর কাছে এই জগতের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হচ্ছে তাঁর মণ্ডলী। COLBen 147.1

“কেননা সদাপ্রভুর প্রজাই তাঁহার দায়াংশ; যাকোবই তাঁহার রিক্ অধিকার। তিনি তাহাকে পাইলেন প্রান্তর দেশে, পশুগর্জনময় ঘোর মরুভূমিতে; তিনি তাহাকে বেষ্টন করিলেন, তাহার তত্ত্ব লইলেন, নয়ন- তারার ন্যায় তাহাকে রক্ষা করিলেন।” দ্বি.বি. ৩২:৯, ১০। “কারণ বাহিনীগণের সদাপ্রভু এই কথা কহেন; প্রতাপের পরে তিনি আমাকে সেই জাতিগণের কাছে পাঠাইলেন, যাহারা তোমাদিগকে লুট করিয়াছে; কেননা যে ব্যক্তি তোমাদিগকে স্পর্শ করে, সে তাঁহার চক্ষুর তারা স্পর্শ করে।” সখরিয় ২:৮। COLBen 147.2

বিধবার আর্জি ছিল “অন্যায়ের প্রতিকার করুন” - “আমার জন্য ন্যায় বিচার করুন” - “আমার বিপক্ষ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন”। এই আবেদন ঈশ্বরের প্রতি তাঁর সন্তানদের প্রার্থনাকে উপস্থাপন করে। শয়তান হচ্ছে ঈশ্বরের মনোনীত সন্তানদের সবচেয়ে বড় বিপক্ষ। সে হচ্ছে “ভ্রাতৃগণের উপরে দোষারোপকারী,” যে দিন রাত ঈশ্বরের সামনে মানুষের সম্পর্কে অভিযোগ করেই চলেছে (প্রকাশিত বাক্য ১২:১০)। ঈশ্বরের লোকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করার জন্য ও দোষারোপ করার জন্য, তাদেরকে প্রবঞ্চিত করার জন্য ও বিনষ্ট করার জন্য সব সময় কাজ করে চলেছে। এই দৃষ্টান্তে খ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, কীভাবে শয়তান ও তার বাহিনীর হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। COLBen 147.3

শয়তান কীভাবে ঈশ্বরের মনোনীতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং যীশু খ্রীষ্ট কীভাবে তাঁর লোকদের বিপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করেন তা সখরিয়ের ভাববাণীর মধ্য দিয়ে বার্তা দেয়া হয়েছে। ভাববাদী সখরিয় বলেছেন, “পরে তিনি আমাকে যিহোশূয় মহাযাজককে দেখাইলেন; ইনি সদাপ্রভুর দূতের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিলেন, আর তাঁহার বিপক্ষতা করিবার জন্য শয়তান [বিপক্ষ] তাঁহার দক্ষিণে দাঁড়াইয়াছিল। তখন সদাপ্রভু শয়তানকে কহিলেন, শয়তান, সদাপ্রভু তোমাকে ভর্ৎসনা করুন; হাঁ, যিনি যিরূশালেমকে মনোনীত করিয়াছেন, সেই সদাপ্রভু তোমাকে ভর্ৎসনা করুন; এই ব্যক্তি কি অগ্নি হইতে উদ্ধৃত অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ স্বরূপ নয়? তখন যিহোশূয় মলিন বস্ত্র পরিহিত হইয়াই দূতের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিলেন।” সখরিয় ৩:১- ৩। COLBen 148.1

ঈশ্বরের মনোনীত লোকদেরকে এখানে বিচারে আনীত অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়েছে। যিহোশূয় এখানে মহা পুরোহিত হয়ে তাঁর লোকদের জন্য আশীর্বাদ যাচ্ঞা করতে এসেছেন, যারা চরম দুঃখ ও দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। যখন তিনি ঈশ্বরের সামনে তাঁর আবেদন উপস্থাপন করছেন সে সময় তার বিপক্ষ হিসেবে শয়তান ডান পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ঈশ্বরের সন্তানদের নামে অভিযোগ করছিল এবং তাদেরকে যতটা সম্ভব ক্ষমার অযোগ্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছিল। সে ঈশ্বরের সম্মুখে তাদের মন্দ কাজ ও ভুল ত্রুটিগুলোকে উপস্থাপন করছিল। সে তাদের ব্যর্থতা ও বিচ্যুতিগুলোর কথা বলছিল এই আশা করে যে, খ্রীষ্টের চোখে সে তাদেরকে এমন মানুষ হিসেবে পরিণত করতে পারবে যাদেরকে খ্রীষ্ট তাঁর অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ আর প্রদান করবেন না। ঈশ্বরের লোকদের প্রতিনিধি হিসেবে আগত যিহোশূয় স্বয়ং অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে নোংরা পোশাক পরে ঈশ্বরের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। লোকদের পাপ সম্পর্কে অবগত হয়ে তিনি অত্যন্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। শয়তান তার আত্মায় এমন এক অপরাধবোধ তৈরি করেছিল যে, তিনি নিজেকে অসহায় বলে মনে করছিলেন। তথাপি সেখানে তিনি একজন আবেদনকারী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং শয়তানও তাঁকে সব দিক থেকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। COLBen 148.2

অভিযোগকারী হিসেবে শয়তানের কাজ শুরু হয়েছে স্বর্গ থেকেই। মানুষের পাপে পতনের সময় থেকেই পৃথিবীতে সে এই কাজ করে যাচ্ছে এবং যত বেশি আমরা পৃথিবীর শেষ কালের দিকে এগিয়ে যাব তত বেশি তার এই অভিযোগ ও দোষারোপ করার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। সে দেখতে পাচ্ছে যে তার সময় ফুরিয়ে আসছে, কাজেই সে আরও একাগ্রতার সাথে মানুষকে প্রবঞ্চিত করার ও তাদেরকে বিনষ্ট করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে। একজন মানুষ যখন এই পৃথিবীতে বাস করে তার শত দুর্বলতা ও পাপময়তা থাকা সত্ত্বেও যিহোবার বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তখন তা দেখে শয়তান ক্রুদ্ধ হয়। মানুষের অযোগ্যতা ও দুর্বলতা দেখে সে খুশি হয় এবং প্রত্যেকটি আত্মার জন্য সে বিশেষ ভাবে ষড়যন্ত্র করে যেন পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে সে ঈশ্বরের কাছ থেকে পৃক করে চিরতরে বিনষ্ট করে দিতে পারে। যারা এই পৃথিবীতে সহানুভূতি ও ক্ষমা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের দয়া ও ভালবাসা প্রদর্শন করেন, তাদেরকে এবং সেই সাথে স্বয়ং ঈশ্বরকে শয়তান অভিযুক্ত করতে চায় ও দোষারোপ করতে চায়। COLBen 149.1

ঈশ্বরের লোকদের জন্য তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ শয়তানের শত্রুতাকে জাগিয়ে তোলে। যখনই ঈশ্বর মানুষের জন্য কাজ করেন, তখনই শয়তান তার ভ্রষ্ট দূতদের নিয়ে সেই কাজ বিনষ্ট করে দেয়ার জন্য নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যারা খ্রীষ্টকে তাদের শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের প্রত্যেকের প্রতি শয়তান ঈর্ষান্বিত হয়। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের অন্তরে মন্দতাকে জাগিয়ে তোলা। যখন সে এই কাজে সফল হয়, তখন সে সমস্ত অভিযোগের তীর ছুড়ে দেয় প্রলোভনের শিকার হওয়া মানুষটির দিকে। সে তাদের নোংরা পোশাকের দিকে ও তাদের ত্রুটিপূর্ণ চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে। সে তাদের দুর্বলতা ও ভুলগুলো, তাদের অকৃতজ্ঞতা, খ্রীষ্টের কাছ থেকে তাদের দূরে সরে যাওয়াকে প্রকাশ করে, যা তাদের ত্রাণকর্তার জন্য অবমাননাকর। এই সমস্ত অভিযোগের মধ্য দিয়ে সে এটাই বোঝাতে চায় যে, তাদেরকে বিনষ্ট করার জন্য সে যা কিছু করেছে তা ছিল ন্যায্য। সে পাপী মানুষের অন্তরে এ ধরনের চিন্তার সঞ্চার করে যে, তার আর কোন আশা নেই, তার হাতে পাপের যে দাগ লেগেছে তা আর কোন কিছু দিয়েই পরিষ্কার করা যাবে না। এভাবে শয়তান মানুষের সমস্ত বিশ্বাস ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করে, যেন সে শয়তানের প্রলোভনে সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত হয় এবং ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্য থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্যুত হয়। COLBen 149.2

সদাপ্রভুর মনোনীত লোকেরা নিজের যোগ্যতায় শয়তানের এই আক্রমণের জবাব দিতে পারে না। নিজেদের ক্ষমতার উপর ভরসা করার চিন্তা করলে তাদের কেবল হতাশই হতে হবে। কিন্তু তাদের আবেদন করতে হবে স্বর্গের মহান মধ্যস্থতাকারীর কাছে। তারা ত্রাণকর্তা খ্রীষ্টের কাছে তাদের প্রার্থনা উপস্থাপন করবে। ঈশ্বর “যেন এক্ষণে যথাকালে আপন ধার্মিকতা দেখান, যেন তিনি নিজে ধার্মিক থাকেন, এবং যে কেহ যীশুতে বিশ্বাস করে, তাহাকেও ধার্মিক গণনা করেন।” রোমীয় ৩:২৬। শয়তানের অভিযোগ বন্ধ করার জন্য এবং তার সমস্ত ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঈশ্বরের সন্তানদেরকে সদাপ্রভুর কাছে ক্রন্দন করতে হবে। “অন্যায়ের প্রতীকার করিয়া আমার বিপক্ষ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন!” এই বলে তাদেরকে প্রার্থনা করতে হবে। তখন খ্রীষ্ট তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর শক্তিতে শয়তানকে নীরব করবেন। COLBen 150.1

“তখন সদাপ্রভু শয়তানকে কহিলেন, শয়তান, সদাপ্রভু তোমাকে ভর্ৎসনা করুন; হাঁ, যিনি যিরূশালেমকে মনোনীত করিয়াছেন, সেই সদাপ্রভু তোমাকে ভর্ৎসনা করুন; এই ব্যক্তি কি অগ্নি হইতে উদ্ধৃত অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ স্বরূপ নয়?” শয়তান যখন ঈশ্বরের লোকদেরকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চায় এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে চায়, তখন খ্রীষ্ট তাকে বাধা দেন। যদিও তারা পাপ করেছে, তথাপি খ্রীষ্ট তাদের পাপের ভার তুলে নিয়ে তাঁর নিজ আত্মায় ধারণ করেছেন। তিনি ইস্রায়েল জাতিকে আগুনের ভেতর থেকে অর্ধদগ্ধ কাঠ টেনে বের করার মত করে উদ্ধার করেছেন। তিনি তাঁর মানবীয় স্বভাবের দিক থেকে মানুষের সাথে সংযুক্ত, অপর দিকে ঐশ্বরিক স্বভাবের দিক থেকে তিনিই স্বয়ং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। তিনি বিনষ্টপ্রায় আত্মার জন্য সহায়তা দান করবেন। শয়তানের সমস্ত বিপক্ষতাকে ভর্ৎসনা করা হবে। COLBen 150.2

“তখন যিহোশূয় মলিন বস্ত্রপরিহিত হইয়াই দূতের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিলেন: তাহাতে সেই দূত আপনার সম্মুখে দণ্ডায়মান ব্যক্তিদিগকে কহিলেন, ইঁহার গাত্র হইতে ঐ মলিন বস্ত্র সকল খুলিয়া ফেল। পরে তিনি তাঁহাকে কহিলেন, দেখ, আমি তোমার অপরাধ তোমা হইতে দূর করিয়া দিয়াছি, ও তোমাকে শুভ্র বস্ত্র পরিহিত করিব। তখন আমি কহিলাম, ইঁহার মস্তকে শুচি উষ্ণীষ দিতে আজ্ঞা হউক। তখন তাঁহার মস্তকে শুচি উষ্ণীষ দেওয়া হইল; এবং তাঁহাকে বস্ত্র পরিধান করান হইল।” তখন বাহিনীগণের সদাপ্রভুর আজ্ঞা অনুসারে স্বর্গদূত যিহোশূয়কে যথাবিহিত সম্মান জ্ঞাপন করলেন, কারণ তিনি ছিলেন ঈশ্বরের লোকদের প্রতিনিধি: “তুমি যদি আমার পথে চল, ও আমার রক্ষণীয়-দ্রব্য রক্ষা কর, তবে তুমিও আমার বাটীর বিচার করিবে, এবং আমার প্রাঙ্গণের রক্ষকও হইবে, আর এই যাহারা দাঁড়াইয়া আছে, আমি তোমাকে ইহাদের মধ্যে গমনাগমন করিবার অধিকার দিব।” যিহোশূয়কে এমন কি ঈশ্বরের চারপাশে দণ্ডায়মান স্বর্গদূতদের মধ্যে গমনাগমন করার অধিকারও দেয়া হয়েছিল (সখরিয় ৩:৩-৭)। COLBen 150.3

ঈশ্বরের লোকদের অনেক খুঁত ও ভুল ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও খ্রীষ্ট তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা এই লোকদের কাছ থেকে দূরে সরে যান নি। তাদেরকে পরিবর্তিত করে তোলার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তিনি তাদের নোংরা পোশাক দূর করে দিয়ে তাদেরকে পরিষ্কার ও শুদ্ধ পোশাক পরান। তাঁর লোকেরা যদি মন পরিবর্তন করে ও অনুতপ্ত হয়, তাহলে তিনি আবারও তাদেরকে ধার্মিকতার পোশাক পরিহিত করেন এবং স্বর্গের জীবন পুস্তকে তাদের নামে ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনি সমগ্র নিখিল বিশ্বের সামনে তাদেরকে তাঁর নিজের লোক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তাদের বিপক্ষ শয়তানকে তিনি দোষারোপকারী ও প্রবঞ্চক হিসেবে সাব্যস্ত করেন। ঈশ্বর তাঁর নিজ মনোনীতদের জন্য সুবিচার করবেন। COLBen 151.1

“অন্যায়ের প্রতীকার করিয়া আমার বিপক্ষ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন!” - এই প্রার্থনায় শুধু যে শয়তানকে বিপক্ষ হিসেবে বোঝানো হয়েছে তা নয়, বরং সেই সাথে শয়তানের যে সমস্ত প্রতিনিধিরা ঈশ্বরের লোকদের বিভিন্ন কথা ও কাজের ভুল ব্যাখ্যা করে, তাদেরকে প্রলোভিত করে এবং বিনষ্ট করে, তাদেরকেও বোঝানো হয়েছে। যারা ঈশ্বরের আদেশ মান্য করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা দ্বারা উপলব্ধি করতে পারবে যে, তাদের বিপক্ষরা অধঃস্থানে অবস্থানকারী এক শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই বিপক্ষরা প্রতিটি ধাপে খ্রীষ্টের কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, যা মানুষ কখনো অনুধাবন করতে পারে না। খ্রীষ্টের শিষ্যরা তাদের প্রভুর মত এই পৃথিবীতে যখনই পথ চলার চেষ্টা করবেন তখনই প্রলোভন তাদের পিছু নেয়া শুরু করবে। COLBen 151.2

পবিত্র শাস্ত্রে খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আগমনের ঠিক আগের পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সে সময় মানুষের মধ্যে যে লোভ ও অন্যায় অপরাধ দেখা দেবে সে সম্পর্কে যাকোব তাঁর পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “এখন দেখ, হে ধনবানেরা, তোমাদের উপরে যে সকল দুর্দশা আসিতেছে, সেই সকলের জন্য রোদন ও হাহাকার কর। তোমাদের ধন পচিয়া গিয়াছে, ও তোমাদের বস্ত্র সকল কীট-ভক্ষিত হইয়াছে; তোমাদের স্বর্ণ ও রৌপ্য কলঙ্কিত হইয়াছে; আর তাহার কলঙ্ক তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে, এবং অগ্নির ন্যায় তোমাদের মাংস খাইবে। তোমরা শেষকালে ধন-সঞ্চয় করিয়াছ। দেখ, যে মজুরেরা তোমাদের ক্ষেত্রের শস্য কাটিয়াছে, তাহারা তোমাদের দ্বারা যে বেতনে বঞ্চিত হইয়াছে, তাহার চিৎকার করিতেছে, এবং সেই শস্যচ্ছেদকদের আর্তনাদ বাহিনীগণের প্রভুর কর্ণে প্রবিষ্ট হইয়াছে। তোমরা পৃথিবীতে সুখভোগ ও বিলাসিতা করিয়াছ, তোমরা হত্যার দিনে আপন আপন হৃদয় তৃপ্ত করিয়াছ। তোমরা ধার্মিককে দোষী করিয়াছ, এবং বধ করিয়াছ; তিনি তোমাদের প্রতিরোধ করেন নাই।” যাকোব ৫:১-৬। এই বর্ণনা আজকের দিনের চিত্রই প্রকাশ করে। এক শ্রেণীর কতিপয় মানুষ সব ধরনের উপায়ে শোষণ ও অনাচারের মধ্য দিয়ে তাদের পার্থিব সম্পদ অর্জন করার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছে, যেখানে পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ ধুঁকে ধুঁকে মরছে, ক্ষুধিত মানবতার কান্নার রোল ঈশ্বরের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছাচ্ছে। COLBen 152.1

“আর বিচার পশ্চাতে হটিয়া পড়িয়াছে, এবং ধার্মিকতা দূরে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে; বস্তুতঃ চকে সত্য উছোট খাইয়া পড়িয়াছে, ও সরলতা প্রবেশ করিতে পায় না। সত্য হারাইয়া গিয়াছে, দুষ্কর্মত্যাগী লোক লুণ্ঠিত হইতেছে।” যিশাইয় ৫৯:১৪, ১৫। পৃথিবীতে যীশু খ্রীষ্টের জীবন ধারণের কালে এই ভবিষ্যদ্বাণী পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। তিনি ঈশ্বরের আদেশের প্রতি অনুগত ছিলেন; তিনি সমস্ত মানবীয় রীতিনীতি ও প্রাকে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র ঈশ্বরের আজ্ঞা ও বিধান পালন করেছিলেন, যেখানে মানুষ ঈশ্বরের বিধানকে সরিয়ে দিয়ে তাদের নিজস্ব মতাদর্শ ও রীতি নীতিকে উচ্চে তুলে ধরেছিলেন। আর এ কারণে খ্রীষ্টকে ঘৃণিত ও নির্যাতিত হতে হয়েছিল। এই ইতিহাসের বার বারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। মানুষ তার নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও আইন কানুনকে ঈশ্বরের বিধানের উপরে বসিয়েছে এবং যারা ঈশ্বরের বিধান পালনে নিষ্ঠা দেখিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে ভর্ৎসনা ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কারণে খ্রীষ্টকে বিশ্রামবার ভঙ্গকারী এবং ঈশ্বরের নিন্দাকারী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। তাঁকে ভূতে পাওয়া বলা হয়েছে এবং তাঁকে বেলসবূবের লোক বলা হয়েছে। একই ভাবে তাঁর শিষ্যদেরও দোষারোপ করা হয়েছে ও মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। এভাবেই শয়তান তাদেরকে পাপের পথে ধাবিত করার আশা করে এবং ঈশ্বরের অমর্যাদা করতে চেষ্টা করে। COLBen 152.2

দৃষ্টান্তে যে বিচারকর্তা ঈশ্বরকে ভয় করত না, মানুষেরও পরোয়া করত না, তার চরিত্রটি দিয়ে খ্রীষ্ট প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর সময়কালীন বিচার ব্যবস্থার কথা; বিশেষ করে যখন তাঁকে বন্দী করা হবে ও বিচারে নিয়ে আসা হবে। তিনি চেয়েছেন যেন সকল যুগে তাঁর লোকেরা বুঝতে পারে যে, বিপক্ষের শাসন চলাকালীন যুগে এই পৃথিবীর বিচারকর্তাদের উপরে আসলে কতটা নির্ভর করা যায়। অনেক সময় এমন লোকদেরকে বিচারকর্তা হিসেবে মনোনীত করা হয় যারা ঈশ্বরের বাক্যকে তাদের দিক নির্দেশনা ও পাথেয় হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং নিজেদের খেয়াল খুশি মত ও মানুষের কথার উপর নির্ভর করে বিচার কাজ পরিচালনা করে থাকে। COLBen 153.1

অধার্মিক বিচারকর্তার দৃষ্টান্তে খ্রীষ্ট দেখিয়েছেন যে, আমাদের কী করা উচিত। “তবে ঈশ্বর কি আপনার সেই মনোনীতদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন না, যাহারা দিবারাত্র তাহার কাছে রোদন করে?” আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ যীশু খ্রীষ্ট নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বা নিজেকে উদ্ধার করার জন্য কিছুই করেন নি। তিনি পুরো বিষয়টি ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। কাজেই তাঁর অনুসারীদেরও অবশ্যই কাউকে দোষারোপ বা অভিযুক্ত করা উচিত হবে না এবং উদ্ধার পাবার জন্য নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করা উচিত হবে না। COLBen 153.2

যখন এমন পরীক্ষা আসে যা আমাদের বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা অতীত, তখন আমাদের কোন ভাবেই বিচলিত হওয়া যাবে না। যতই আমাদের প্রতি অন্যায্য আচরণ করা হোক না কেন, নিজেদের ভেতরের ক্রোধ সম্বরণ করতে হবে। পাল্টা আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল নিজেদেরই ক্ষতি করি। ঈশ্বরের প্রতি আমাদের যে বিশ্বাস রয়েছে সেই বিশ্বাসকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত করি এবং পবিত্র আত্মাকে দুঃখ দিই। আমাদের পাশে একজন সাক্ষী রয়েছেন, একজন স্বর্গীয় বার্তাবাহক রয়েছেন, যিনি আমাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। তিনি আমাদেরকে ধার্মিকতার সূর্যের অতি উজ্জ্বল রশ্মি দ্বারা রক্ষা করবেন। শয়তান এই বাধা পার হতে পারে না। এই পবিত্র আলোক রশ্মির বর্ম শয়তান ভেদ করতে পারে না। COLBen 154.1

পৃথিবী যেখানে এতটা বেশি মন্দতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, সেখানে আমাদের নিজেদের এই ধারণা মোটেও পোষণ করা উচিত নয় যে, আমাদের কোন সমস্যা নেই। বরং এই সমস্ত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার জন্যই আমাদের উচিত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে উপস্থিত হওয়া। অসীম জ্ঞানের অধিকারী যিনি, তাঁর কাছ থেকেই আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। COLBen 154.2

প্রভু বলেছেন, “আর সঙ্কটের দিনে আমাকে ডাকিও; আমি তোমাকে উদ্ধার করিব, ও তুমি আমার গৌরব করিবে।” গীত ৫০:১৫। তিনি তাঁর কাছে আমাদের সমস্ত জটিলতা ও প্রয়োজনগুলো উপস্থাপন করতে বলেছেন এবং আমাদের যে সকল বিষয়ে ঐশ্বরিক সহায়তা প্রয়োজন সেগুলো প্রকাশ করতে বলেছেন। তিনি আমাদেরকে সব সময় প্রার্থনা করতে বলেছেন। যখনই কোন সমস্যায় পড়ব তখনই আমাদের উচিত হবে তাঁর কাছে আন্তরিক ভাবে আমাদের আবেদন উপস্থাপন করা। একাগ্রতা ও ঐকান্তিকতার সাথে তাঁর কাছে প্রার্থনা করার মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করি। যখন আমরা অনুভব করব, যে আমাদের কোন কিছুর অভাব রয়েছে, তখনই আমরা একাগ্রতার সাথে প্রার্থনা করব এবং আমাদের স্বর্গস্থপিতা আমাদের প্রার্থনায় সাড়া দেবেন। COLBen 154.3

যারা তাদের বিশ্বাসের কারণে লাঞ্ছনা বা নির্যাতনের শিকার হন তারা অনেক সময় এই চিন্তা করার জন্য প্রলুব্ধ হন যে, ঈশ্বর তাদেরকে ত্যাগ করেছেন। মানুষের চোখে তারা হয়ে দাঁড়ান সংখ্যালঘু। আপাতদৃষ্টিতে সমস্ত দিক থেকে তাদের শত্রুরা তাদের উপরে বিজয় লাভ করতে থাকে। কিন্তু তাদের কখনোই নিজেদের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত হবে না। যিনি তাদের জন্য ক্রুশে দুঃখভোগ করেছেন এবং যিনি তাদের সমস্ত যাতনা ও বাথ্যা সকল সহ্য করেছেন, তিনি কখনো তাদেরকে ভুলে যাবেন না। COLBen 154.4

ঈশ্বরের সন্তানদেরকে কখনোই একাকী ও অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়া হবে না। প্রার্থনা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বাহুকে সক্রিয় করে তোলে। প্রার্থনার দ্বারা বিশ্বাসীরা “নানা রাজ্য পরাজিত করিলেন, ধার্মিকতার অনুষ্ঠান করিলেন, নানা প্রতিজ্ঞার ফলপ্রাপ্ত হইলেন, সিংহদের মুখ বদ্ধ করিলেন, অগ্নির তেজ নির্বাপিত করিলেন” - খ্রীষ্টের প্রতি নিজেদের বিশ্বাসে স্থির থাকার জন্য যারা আগুনে পুড়ে আত্মত্যাগ করেছেন তাদের বিষয়ে এখানে বলা হয়েছে - “খড়গের মুখ এড়াইলেন, দুর্বলতা হইতে বলপ্রাপ্ত হইলেন, যুদ্ধে বিক্রান্ত হইলেন, অন্যজাতীয়দের সৈন্যশ্রেণী তাড়াইয়া দিলেন।” ইব্রীয় ১১:৩৩, ৩৪। COLBen 155.1

যদি আমরা আমাদের জীবন ঈশ্বরের সেবা কাজের জন্য উৎসর্গ করি, তাহলে আমাদের জন্য তিনি যে স্থান নির্ধারণ করেছেন তা ব্যতীত আর কোন অবস্থানে আমরা যেতে পারব না। আমাদের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আমাদের জীবনকে দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্য একজন পথ নির্দেশক আমাদের সাথে রয়েছেন; আমাদের জীবনে যত জটিলতাই থাকুক না কেন আমাদের একজন পরামর্শ দাতা রয়েছেন; আমাদের যত দুঃখ, অপূর্ণতা বা একাকীত্বই থাকুক না কেন, আমাদের একজন সমবেদনাপূর্ণ বন্ধু রয়েছেন। যদি আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা কোন ভুল করে বসি, তাহলে খ্রীষ্ট কখনোই আমাদেরকে ছেড়ে যাবেন না। তিনি সুস্পষ্ট ও দৃঢ় প্রত্যয়ী কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, “আমিই পথ ও সত্য ও জীবন।” যোহন ১৪:৬। “কেননা তিনি আর্তনাদকারী দরিদ্রকে, এবং দুঃখী ও নিঃসহায়কে উদ্ধার করিবেন।” গীত ৭২:১২। COLBen 155.2

প্রভু ঘোষণা করেছেন যে, যারা নিজেদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে চায়, যারা বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর সেবা করতে চায়, তাদের দ্বারা তিনি সম্মানিত হবেন। “যাহার মন তোমাতে সুস্থির, তুমি তাহাকে শান্তিতে, শান্তিতেই রাখিবে, কেননা তোমাতেই তাহার নির্ভরতা।” যিশাইয় ২৬:৩। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বাহু আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্য পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রভু বলছেন, তুমি এগিয়ে চল, আমি তোমার সহায় হব। তোমরা আমাদের নামের গৌরবের জন্যই যাচ্ঞা করেছ এবং তোমরা তা পাবে। যারা তোমাদের ব্যর্থতা দেখতে পায় তাদের সামনে আমি তোমাদের মধ্য দিয়ে গৌরবান্বিত হব। তারা আমার বাক্যের গৌরবময় বিজয় দেখতে পাবে। “আর তোমরা প্রার্থনায় বিশ্বাসপূর্বক যাহা কিছু যাচ্ঞা করিবে, সেই সকলই পাইবে।” মথি ২১:২২। COLBen 155.3

যারা পীড়িত ও অন্যায্য আচরণের শিকার, তারা ঈশ্বরের কাছে ক্রন্দন করুক। যাদের অন্তর ইস্পাতের ন্যায় কঠিন তাদের কাছ থেকে সরে আসুন এবং আপনার যাচ্ঞার বিষয় আপনার সৃষ্টিকর্তাকে জানান। যে কেউ প্রভুর কাছে দুঃখার্ত অন্তর নিয়ে যাচ্ঞা করতে এসেছে সে কখনো তাঁর কাছ থেকে ফিরে যায় নি। আন্তরিক ভাবে করা কোন প্রার্থনা কখনো প্রভু প্রত্যাখ্যান করেন না। স্বর্গীয় সঙ্গীতের ধ্বনির মাঝেও ঈশ্বর ঠিকই সবচেয়ে দুর্বল মানুষটির কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। আমরা আমাদের অন্তরের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা মুখ ফুটে বলব, আমরা প্রতিটি পদে পদে চলার সময় প্রার্থনা করব, এবং আমাদের কথা নিখিল বিশ্বের অধিকর্তার সিংহাসনের কাছে গিয়ে পৌঁছাবে। তা যে কোন মানুষের কানের অশ্রবণযোগ্য হবে, কিন্তু তাই বলে নীরবতার মধ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করা তাদের শোভা যায় না, কিংবা তারা পৃথিবীতে যে সমস্ত কাজে লিপ্ত আছে তার মধ্য দিয়ে তারা চিরতরে হারিয়ে যাবে, সেটাও হয় না। কোন কিছুই আত্মার আকাঙ্ক্ষাকে নিবারণ করতে পারে না। তা রাস্তা ছাড়িয়ে ঘরের উঠোনে চলে আসে, তা সমস্ত বিরাট জনসমাগমের সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের উপরে স্থান নেয়, এবং সবশেষে তা স্বর্গীয় পিতার বিচারালয়ে অবস্থান পায়। প্রার্থনায় আমরা ঈশ্বরের সাথে কথা বলি এবং এ কারণেই আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করা হবে। COLBen 156.1

আপনারা যারা নিজেদেরকে অযোগ্য বলে মনে করেন, তারা নিজেদের ঈশ্বরকে বলার জন্য দ্বিধা করবেন না। তিনি যখন খ্রীষ্টকে এই জগতের পাপের জন্য দান করেছিলেন, তখন তিনি প্রত্যেকটি আত্মার অবস্থা জেনে গিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেকের জন্যই মুক্তি সাধন করেছিলেন। “যিনি নিজ পুত্রের প্রতি মমতা করিলেন না, কিন্তু আমাদের সকলের নিমিত্ত তাঁহাকে সমর্পণ করিলেন, তিনি কি তাঁহার সহিত সমস্তই আমাদিগকে অনুগ্রহপূর্বক দান করিবেন না?” রোমীয় ৮:৩২। আমাদের উৎসাহ ও বল লাভের জন্য তিনি কি তাঁর অনুগ্রহপূর্ণ বাক্যের পরিপূর্ণতা সাধন করবেন না? COLBen 156.2

শয়তানের অধীনতা থেকে উদ্ধার করার চেয়ে খ্রীষ্টের সবচেয়ে বড় চাওয়া আর নেই। কিন্তু শয়তানের ক্ষমতার অধীন থেকে মুক্ত হওয়ার আগে আমাদের অবশ্যই তার ক্ষমতাকে জয় করতে হবে। প্রভু আমাদের জন্য পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছেন যেন আমরা সমস্ত জাগতিকতা, স্বার্থপরতা, কলুষতা, ও খ্রীষ্টের স্বভাব বহির্ভূত আচরণ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করি। তিনি আমাদের আত্মাকে মুক্ত করার জন্য অতল সমুদ্রের মত দুঃখভোগের শিকার হয়েছেন, যেন আমরা যীশু খ্রীষ্টকে এবং যিনি তাঁকে পাঠিয়েছেন সেই পিতা ঈশ্বরকে জানতে পারি। কারণ এতে করে আমরা সমস্ত প্রকার পাপময় কলুষতা থেকে মুক্ত হতে পারব এবং সত্যিকার পবিত্র, পরিষ্কৃত, ও আনন্দিত চিত্তে ঈশ্বরের কাছে আসতে পারব। অনেক সময় আমরা স্বার্থপরতায় পূর্ণ অন্তর নিয়ে পরীক্ষায় প্রবেশ করি। কিন্তু যদি আমরা অত্যন্ত গুরুতর পরীক্ষার সময়েও ধৈর্য ধারণ করি তাহলে আমাদের মধ্য দিয়ে ঐশ্বরিক চরিত্র প্রকাশিত হবে। যখন আমাদের দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে প্রভুর উদ্দেশ্য সম্পন্ন হবে, তখন “তিনি দীপ্তির ন্যায় তোমার ধর্ম, মধ্যাহ্নের ন্যায় তোমার বিচার প্রকাশ করিবেন।” গীতসংহিতা ৩৭:৬। COLBen 157.1

প্রভু তাঁর লোকদের প্রার্থনা অবজ্ঞা করবেন এমন কোন ভয় নেই। ভয় সেই সমস্ত প্রলোভন এবং পরীক্ষাতে, যেগুলো তারা প্রার্থনায় উৎসাহ হারিয়ে ফেললে তাদের জীবনে দেখা দেবে এবং তাতে তারা প্রার্থনায় একাগ্র তা হারিয়ে ফেলে। COLBen 157.2

আমাদের ত্রাণকর্তা খ্রীষ্ট সূর-ক্সফনিকীয় নারীটির প্রতি স্বর্গীয় দয়া ও করুণা প্রকাশ করেছিলেন। মহিলাটির দুঃখ দুর্দশা তাঁর অন্তরকে স্পর্শ করেছিল। তিনি তাকে সঙ্গে সঙ্গে এই নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছিলেন যে, তার প্রার্থনা গ্রাহ্য হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর শিষ্যদেরকে একটি শিক্ষা দিতে চাইলেন। আর প্রথমে কিছু সময়ের জন্য আপাতদৃষ্টিতে তিনি সেই নারীর অন্তরের যন্ত্রণাদায়ক কান্না শুনছিলেন না। যখন সেই নারী তার বিশ্বাস প্রকাশ করল, তখন খ্রীষ্ট তার প্রতি প্রশংসা সূচক কথা বললেন এবং সে যে আশীর্বাদ চেয়েছিল তা দান করে দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন। শিষ্যরা এই শিক্ষা কখনো ভোলেন নি এবং ধৈর্য পূর্বক প্রার্থনা করার নিদর্শন হিসেবে এই ঘটনাটি পবিত্র শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। COLBen 157.3

স্বয়ং খ্রীষ্ট সেই মায়ের অন্তরে ধৈর্য ও দীর্ঘসহিষ্ণুতা স্থাপন করেছিলেন যা কখনো নির্বাপিত হওয়ার নয়। খ্রীষ্ট নিজেই বিচার চাইতে আসা বিধবাকে বিচারকর্তার সামনে বার বার আসার জন্য সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয় দান করেছিলেন। খ্রীষ্টই বহু শতাব্দী পূর্বে যব্বোক নদীর তীরে সেই রহস্যময় মল্ল যুদ্ধে যাকোবকে এই একই দৃঢ় বিশ্বাস প্রদান করেছিলেন। তিনি নিজে আমাদের অন্তরে যে বিশ্বাস স্থাপন করে তা কখনো ব্যর্থ হয় না। COLBen 158.1

যিনি স্বর্গীয় ধর্মধামে বাস করেন, তিনি ধার্মিকতার সাথে বিচার করেন। তিনি তাঁর সিংহাসনের চারপাশে অবস্থানকারী দূতগণের বাহিনীকে দেখার চেয়ে তাঁর মনোনীত লোকদেরকে দেখে আরও বেশি আনন্দিত হন, যারা এই পাপময় পৃথিবীতে প্রলোভনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই পৃথিবীর প্রতি সমগ্র নিখিল বিশ্বের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে, কারণ খ্রীষ্ট এই পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য এক মহা মূল্য প্রদান করেছেন। COLBen 158.2

এই পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা তাঁর নিজ গুণে পৃথিবীকে স্বর্গের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন, কারণ প্রভু যাদেরকে উদ্ধার করেছেন তারা এই পৃথিবীর বাসিন্দা। অব্রাহাম ও মোশীর সময়ে যেমন স্বর্গীয় সত্তাগণ এই পৃথিবীতে বিচরণ করতেন, তেমনি এখনও এই পৃথিবীতে তাঁদের পদচারণা রয়েছে। আমাদের মহানগরীগুলোর অবিশ্রান্ত ব্যস্ততার মধ্যে, জনতার ভিড়ের মধ্যে, যেখানে প্রতি দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়াচ্ছে, যেখানে কঠোর ও কর্কশ বাস্তবতা ব্যতীত আর কোন কিছুর অবকাশ নেই - সেখানেও স্বর্গ ও তার পবিত্র বাসিন্দাদের দৃষ্টি সব সময় বিরাজমান রয়েছে। মানব জাতির প্রত্যেকটি কথা ও কাজ স্বর্গের অদৃশ্য সত্তাগণ প্রতি নিয়ত লক্ষ করছেন। ব্যবসায় বা বিনোদনের জন্য যেখানে মানুষ জমায়েত হয়, যখন মানুষ ঈশ্বরের উপাসনার জন্য একত্রিত হয়, সেখানে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে যত সমাগত শ্রোতা পরিলক্ষিত হয়, অদৃশ্য ভাবে প্রকৃত পক্ষে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি শ্রোতার উপস্থিতি সেখানে থাকে। অনেক সময় স্বর্গীয় এই সত্তাগণ নিজেদেরকে এই পর্দার আড়াল থেকে বের করে নিয়ে আসেন, যে পর্দার কারণে আমরা তাদেরকে পৃথিবীতে দেখতে পাই না, যেন আমরা এই ব্যস্ত পৃথিবীর কর্ম চাঞ্চল্য থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মুখ তুলে তাকাই এবং আমাদের চারপাশে ঈশ্বরের যে অদৃশ্য উপস্থিতির সাক্ষ্য সব সময় অবস্থান করছে তা যেন আমরা চোখে দেখতে পাই। COLBen 158.3

এই পৃথিবীতে অদৃশ্য আগন্তুক স্বর্গদূতদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের আরও ভাল করে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। ঐশ্বরিক আলো ও শক্তির স্বর্গীয় বাহিনী সেই সমস্ত নম্র ও মৃদু স্বভাবের মানুষের কাছে এসে উপস্থিত হন, যারা ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর উপরে নির্ভর করে। করূব ও সরাফ এবং অন্যান্য যে সকল স্বর্গদূতেরা শক্তিমত্তায় তুলনাহীন, যারা দশ সহস্র অযুতের দশ হাজার গুণ শক্তিশালী, তাঁরা প্রভুর ডান পাশে দণ্ডায়মান থাকেন। “উঁহারা সকলে কি সেবাকারী আত্মা নহেন? যাহারা পরিত্রাণের অধিকারী হইবে, উঁহারা কি তাহাদের পরিচর্যার জন্য প্রেরিত নহেন?” ইব্রীয় ১:১৪। COLBen 159.1

এই সকল স্বর্গদূতের মধ্য দিয়ে মনুষ্য সন্তানদের সমস্ত কথা ও কাজের সঠিক ও বিশ্বস্ত হিসেব লিপিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। ঈশ্বরের লোকদের প্রতি যারা অত্যাচার ও নিপীড়ন চালায়, শয়তানের সেই সমস্ত কার্যকারীদের নাম স্বর্গে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। COLBen 159.2

“তবে ঈশ্বর কি আপনার সেই মনোনীতদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন না, যাহারা দিবারাত্র তাহার কাছে রোদন করে, যদিও তিনি তাঁহাদের বিষয়ে দীর্ঘসহিষ্ণু? আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, তিনি শীঘ্রই তাহাদের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিকার করিবেন।” COLBen 159.3

“অতএব তোমাদের সেই সাহস ত্যাগ করিও না, যাহা মহাপুরস্কারযুক্ত। কেননা ধৈর্যে তোমাদের প্রয়োজন আছে, যেন ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করিয়া প্রতিজ্ঞার ফল প্রাপ্ত হও। কারণ ‘‘আর অতি অল্পকাল বাকী আছে, যিনি আসিতেছেন, তিনি আসিবেন, বিলম্ব করিবেন না।” ইব্রীয় ১০:৩৫-৩৭। “অতএব হে ভ্রাতৃগণ, তোমরা প্রভুর আগমন পর্যন্ত দীর্ঘসহিষ্ণু থাক। দেখ, কৃষক ভূমির বহুমূল্য ফলের অপেক্ষা করে এবং যত দিন তাহা প্রথম ও শেষ বর্ষা না পায়, ততদিন তাহার বিষয়ে দীর্ঘসহিষ্ণু থাকে। তোমরাও দীর্ঘসহিষ্ণু থাক, আপন আপন হৃদয় সুস্থির কর, কেননা প্রভুর আগমন সন্নিকট।” যাকোব ৫:৭,৮। COLBen 159.4

ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতা তুলনাহীন। পাপী মানুষের প্রতি দয়া ও করুণার কারণে ঈশ্বর তাঁর বিচারে বিলম্ব করেন। কিন্তু “ধর্মশীলতা ও বিচার তাঁহার সিংহাসনের ভিত্তিমূল,” গীতসংহিতা ৯৭:২। “সদাপ্রভু ক্রোধে ধীর ও পরাক্রমে মহান, এবং তিনি অবশ্য [পাপের] দণ্ড দেন; ঘূর্ণবায়ু ও ঝড় সদাপ্রভুর পথ, মেঘ তাঁহার পদধূলি,” নহূম ১:৩। COLBen 160.1

এই জগত ঈশ্বরের বিধান অমান্য করতে করতে অনেক বেশি দুঃসাহসী হয়ে পড়েছে। ঈশ্বরের দীর্ঘসহিষ্ণুতার জন্য মানুষ তাঁর কর্তৃত্বকে অবমূল্যায়ন করতে শুরু করেছে। মানুষ একে অপরের উপরে শোষণ ও নিপীড়নে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং তাঁর সৃষ্টি জগতের উপরে আঘাত হানছে। তারা বলে, “ঈশ্বর কি রূপে জানিবেন? পরাৎপরের কি জ্ঞান আছে?” গীতসংহিতা ৭৩:১১। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে যা তারা কখনো অতিক্রম করতে পারে না। তাদের জন্য নিরূপিত সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। খুব শীঘ্র তারা সেই সীমারেখা অতিক্রম করতে চলেছে। এমন কি এখনও তারা দীর্ঘসহিষ্ণু ঈশ্বরের ধৈর্যের বাধ, তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের সীমারেখা প্রায় শেষ করার পর্যায়ে চলে এসেছে। প্রভু তাঁর সম্মান রক্ষা করার জন্য, তাঁর লোকদেরকে উদ্ধার করার জন্য, এবং অধার্মিকতাকে সমূলে বিনাশ করার জন্য উদ্যোগ নেবেন। COLBen 160.2

নোহের সময়ে মানুষ ঈশ্বরের আইন অমান্য করতে করতে এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যে, ঈশ্বরের সৃষ্টির স্মৃতি জগত থেকে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনৈতিকতা এমন এক স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যে, প্রভু এই পৃথিবীতে মহা বন্যা পাঠিয়েছিলেন, এর দুষ্ট অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। COLBen 160.3

যুগে যুগে প্রভু তাঁর কাজের ধারা মানুষকে জ্ঞাত করেছেন। যখন কোন একটি জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, তিনি সেখানে নিজেকে প্রকাশ করেছেন, এবং শয়তানের সমস্ত পরিকল্পনা ও কাজ বন্ধ করেছেন। বিভিন্ন জাতি, পরিবার, ও ব্যক্তির সাথে তিনি এ ধরণের সমস্যার মুখে প্রত্যক্ষ ভাবে সংযোগ সাধন করেছেন, যেন তাঁর উপস্থিতি সহজে চিহ্নিত করা যায়। এর পর তিনি পুরো পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেছেন যে, ইস্রায়েলের এমন এক ঈশ্বর আছেন, যিনি তাঁর বিধান লঙ্ঘিত হতে দেন না এবং তিনি তাঁর নিজ মনোনীত লোকদেরকে রক্ষা করেন। COLBen 160.4

অধার্মিকতা প্রলুব্ধ এই যুগে আমাদের এ কথা ভাল করে জেনে রাখা ভাল যে, খুব শীঘ্র ভয়ঙ্কর এক সময় আসছে। যখন এই সমগ্র বিশ্ব ঈশ্বরের সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে, যখন তাঁর মনোনীত লোকেরা তাঁরই সৃষ্ট অন্য মানুষের হাতে শোষিত ও নিপীড়িত হতে থাকবে, তখনই ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করবেন। COLBen 161.1

সেই সময় খুব কাছে এসে গেছে, যখন ঈশ্বর বলবেন, “হে আমার জাতি, চল, তোমার অন্তরাগারে প্রবেশ কর, তোমার দ্বার সকল রুদ্ধ কর; অল্পক্ষণ মাত্র লুক্কায়িত থাক, যে পর্যন্ত ক্রোধ অতীত না হয়। কেননা দেখ, সদাপ্রভু আপন স্থান হইতে নির্গমন করিতেছেন, পৃথিবী-নিবাসীদের অপরাধের প্রতিফল দিবার নিমিত্ত; পৃথিবী আপনার উপরে পাতিত রক্ত প্রকাশ করিবে, আপনার নিহতদিগকে আর আচ্ছাদিত রাখিবে না।” যিশাইয় ২৬:২০, ২১। যে সমস্ত মানুষ নিজেকে তথাকথিত খ্রীষ্টান বলে দাবী করে তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো দরিদ্রদের উপরে অত্যাচার করতে পারে ও তাদেরকে বঞ্চিত করতে পারে; হয়তো তারা বিধবা ও অনাথদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে যেতে পারে; হয়তো ঈশ্বরের লোকদের অন্তরে অধিকার স্থাপন করতে না পেরে তাদের শয়তান সুলভ ক্রোধ প্রকাশ করতে পারে; কিন্তু এই সব কিছুর জন্য ঈশ্বর তাদেরকে বিচারে দাঁড় করাবেন। “কেননা যে ব্যক্তি দয়া করে নাই, বিচার তাহার প্রতি নির্দয়; দয়াই বিচারজয়ী হইয়া শ্লাঘা করে” (যাকোব ২:১৩)। সমগ্র বিশ্বের বিচারকর্তার সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে তাদের আর খুব বেশি দেরি নেই। ঈশ্বরের সৃষ্ট ও মনোনীত মানুষদের দেহ ও আত্মার প্রতি তারা যে পীড়ন ও নিষ্পেষণ চালিয়েছে, তার জন্য তাদেরকে জবাব দিতেই হবে। তারা হয়তো এখন ঈশ্বরের লোকদের উপরে মিথ্যা অভিযোগ আনবে, যাদেরকে ঈশ্বর তাঁর কাজ করার জন্য এই পৃথিবীতে নিযুক্ত করেছেন তাদেরকে হয়তো তারা ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করবে ও তাদের নামে দোষারোপ করবে। তারা এখন ঈশ্বরের মনোনীত মানুষদেরকে কারারুদ্ধ করবে, শেকলে বেঁধে রাখবে, নির্বাসনে দেবে, কিংবা হত্যা করবে। কিন্তু ঈশ্বরের লোকদের মধ্যে যে কোন একজনের আর্তনাদ, কিংবা এক ফোঁটা মাত্র চোখের জলের কারণে এই সকল দুষ্কৃতিকারীদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। ঈশ্বর তাদের পাপের জন্য দ্বিগুণ কর্মফল দেবেন। অধার্মিক মণ্ডলীর নিদর্শন বাবিল সম্পর্কে তিনি তাঁর বিচার কাজ সাধনকারীদেরকে বলেছেন, “কেননা উহার পাপ আকাশ পর্যন্ত সংলগ্ন হইয়াছে এবং ঈশ্বর উহার অপরাধ সকল স্মরণ করিয়াছেন। সে যেরূপ ব্যবহার করিত, তোমরাও তাহার প্রতি সেইরূপ ব্যবহার কর; আর তাহার ক্রিয়ানুসারে দ্বিগুণ, দ্বিগুণ প্রতিফল তাহাকে দেও; সে যে পাত্রে পেয় প্রস্তুত করিত, সেই পাত্রে তাহার জন্য দ্বিগুণ পরিমাণে পেয় প্রস্তুত কর।” প্রকাশিত বাক্য ১৮:৫, ৬। COLBen 161.2

ভারত থেকে, আফ্রিকা থেকে, চীন থেকে, সাগরের বুকে জেগে থাকা দ্বীপসমূহ থেকে, তথাকথিত সমস্ত খ্রীষ্টান দেশ থেকে মানবাত্মার হাহাকার ও কান্নার রোল ঈশ্বরের কাছে উঠে এসেছে। এই কান্নার জবাব খুব শীঘ্রই দেয়া হবে। ঈশ্বর এই পৃথিবীকে তার সমস্ত নৈতিক কলুষতা থেকে মুক্ত করবেন। কিন্তু নোহের সময়কার মত বন্যার মধ্য দিয়ে নয়, বরং তিনি এবার এমন এক আগুনের সমুদ্র নিয়ে আসবেন যা কোন মানবীয় প্রচেষ্টায় নির্বাপণ করা সম্ভব হবে না। COLBen 162.1

“তৎকালে যে মহান অধ্যক্ষ তোমার জাতির সন্তানদের পক্ষে দাঁড়াইয়া থাকেন, সেই মীখায়েল উঠিয়া দাঁড়াইবেন, আর এমন সঙ্কটের কাল উপস্থিত হইবে, যাহা মনুষ্যজাতির স্থিতিকাল অবধি সেই সময় পর্যন্ত কখনও হয় নাই; কিন্তু তৎকালে তোমার স্বজাতীয় যে কাহারও নাম পুস্তকে লিখিত পাওয়া যাইবে, সে উদ্ধার পাইবে।” দানিয়েল ১২:১। COLBen 162.2

ছাদের চিলেকোঠা থেকে, ছাউনি ঘর থেকে, ভূগর্ভস্থকক্ষ থেকে, বিচার মঞ্চ থেকে, পর্বত ও মরুভূমি থেকে, পাহাড়ের অভ্যন্তরের গুহা ও সমুদ্রের গিরিখাদ থেকে খ্রীষ্ট তাঁর নিজ সন্তানদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে আসবেন। এই পৃথিবীতে তারা নিঃস্ব, দরিদ্র, ও পীড়িত অবস্থায় জীবন ধারণ করেছে। শয়তানের দাসত্ব ও কর্তৃত্বের অধীনে আসতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে কোটি কোটি মানুষকে লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণা সহ্য করে কবরস্থ হতে হয়েছে। মানবীয় বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সন্তানদেরকে সবচেয়ে ঘৃণিত অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু এমন এক দিন আসছে যখন “ঈশ্বর স্বয়ং বিচারকর্তা” হবেন (গীতসংহিতা ৫০:৬)। তখন পৃথিবীতে যত বিচার ঘটেছে তার রায় পাল্টে যাবে। তখন ঈশ্বর “সমস্ত পৃথিবী হইতে আপন প্রজাদের দুর্নাম দূর করিবেন।” যিশাইয় ২৫:৮। তাদের প্রত্যেককে সাদা রংয়ের পোশাক পরিধান করতে দেয়া হবে (প্রকাশিত বাক্য ৬:১১)। “আর তাহাদিগকে বলা যাইবে, ‘পবিত্র প্রজা’, ‘সদাপ্রভুর মুক্ত লোক’।” যিশাইয় ৬২:১২। COLBen 162.3

ঈশ্বরের সন্তানদেরকে যে ক্রুশই বহন করতে বলা হোক না কেন, তাদেরকে যে ক্ষতিই স্বীকার করতে বলা হোক না কেন, তারা যত দুঃখ কষ্ট ও নির্যাতনই সহ্য করুক না কেন, এমন কি তারা যদি তাদের এই পার্থিব জীবনও হারিয়ে ফেলে, তথাপি তাদের সমস্ত ক্ষতি ঈশ্বর নিজে পূরণ করে দেবেন। ঈশ্বরের সন্তানেরা “তাঁহার মুখ দর্শন করিবে, এবং তাঁহার নাম তাহাদের ললাটে থাকিবে।” প্রকাশিত বাক্য ২২:৪। COLBen 163.1