খ্রীষ্টের দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা
বীজবাপকের দৃষ্টান্ত থেকে অন্যান্য শিক্ষা
বীজ বপন ও বীজ থেকে তৃণের বেড়ে ওঠা নিয়ে পরিবারে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক মূল্যবান শিক্ষা দেয়া যায়। প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদানের মাঝে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করাটা শিশুদের ও তরুণদের শেখানো প্রয়োজন; এতে অদৃশ্য উপকারগুলো তারা বিশ্বাসে আকড়ে ধরবে। যখন তারা বুঝতে শুরু করবে যে, ঈশ্বর তাঁর এই বৃহৎ পরিবারের অভাব পূরণে কী চমৎকার কার্য সাধন করছেন এবং আমাদের কীভাবে তাঁর সাথে সহযোগিতা করা উচিত, তখন তারা ঈশ্বরের উপরে আরও বেশি করে বিশ্বাস স্থাপন করবে, এবং তারা তাদের নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অনুধাবন করতে পারবে। COLBen 64.1
ঈশ্বর যেভাবে তাঁর বাক্যের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে তিনি এই বীজও সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বাক্যের মধ্য দিয়ে তিনি তাকে বেড়ে ওঠার ও সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ভূমি তৃণ, বীজোৎপাদক ঔষধি ও সবীজ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফলবৃক্ষ ভূমির উপরে উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। . . . আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সেই সকল উত্তম।” আদিপুস্তক ১:১১, ১২। সেই বাক্যের জন্য আজও প্রতিটি বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে। সূর্যের কিরণে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠা প্রত্যেকটি সবুজ পাতা ঘোষণা করে তাঁর বাক্যের আশ্চর্য কার্য সাধনকারী ক্ষমতার কথা, যিনি “কথা কহিলেন, আর উৎপত্তি হইল;” যিনি “আজ্ঞা করিলেন, আর স্থিতি হইল।” গীতসংহিতা ৩৩:৯। COLBen 64.2
খ্রীষ্ট তাঁর শিষ্যদেরকে প্রার্থনায় এ কথা বলতে শিক্ষা দিয়েছিলেন, “আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আজ আমাদিগকে দেও।” মাঠের ফুলের দিকে নির্দেশ করে তিনি তাদেরকে এই নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, “ক্ষেত্রের যে তৃণ আজ আছে . . . তাহা যদি ঈশ্বর এইরূপ বিভূষিত করেন, তবে হে অল্প বিশ্বাসীরা, তোমাদিগকে কি আরও অধিক নিশ্চয় বিভূষিত করিবেন না?” মথি ৬:১১, ৩০। খ্রীষ্ট আমাদের এই প্রার্থনার ফল দানের জন্য অনবরত কাজ করে চলেছেন এবং তিনি তাঁর এই আশ্বাস বিশ্বস্ততার সাথে রক্ষা করছেন। তাঁর পক্ষ থেকে একটি অদৃশ্য শক্তি সব সময় মানুষের খাওয়া ও পরার তত্ত্বাবধান করে চলেছে। ফেলে দেয়া বীজ থেকে একটি জীবন্ত উদ্ভিদের জন্ম দেয়ার জন্য আমাদের প্রভু তাঁর নানাবিধ প্রতিনিধিকে কার্যে নিয়োজিত রেখেছেন। এই বীজ থেকে যথা সময়ে যেন সর্বোত্তম ফসল উৎপন্ন হতে পারে সে জন্য তিনি সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছেন। গীতসংহিতার এই অপূর্ব গীতটি লক্ষ করুন: COLBen 64.3
“তুমি পৃথিবীর তত্ত্বাবধান করিতেছ,
উহাতে জল সেচন করিতেছ,
উহা অতিশয় ধনাঢ্য করিতেছ;
ঈশ্বরের নদী জলে পরিপূর্ণ;
এইরূপে ভূমি প্রস্তুত করিয়া তুমি
মনুষ্যদের শস্য প্রস্তুত করিয়া থাক।
তুমি তাহার সীতা সকল জলসিক্ত করিয়া থাক,
তাহার আলি সকল সমান করিয়া থাক,
তুমি বৃষ্টি দ্বারা তাহা কোমল করিয়া থাক,
তাহার অঙ্কুরকে আশীর্বাদ করিয়া থাক।
তুমি আপন মঙ্গলভাবের বৎসরকে মুকুট পরাইয়া থাক,
তোমার চক্রচিহ্ন দিয়া পুষ্টিকর দ্রব্য ক্ষরে।”
COLBen 65.1
গীতসংহিতা ৬৫:৯-১১
এই পার্থিব জগত ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণাধীনে রয়েছে। প্রকৃতির সমস্ত বিধানগুলো স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নির্দেশ মত চলছে। সব কিছুই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে ও সে অনুসারেই কাজ করে। মেঘ ও সূর্য কিরণ, শিশির ও বৃষ্টি, বাতাস ও ঝড়, সব কিছুই ঈশ্বরের তত্ত্বাবধানের অধীনে রয়েছে এবং এগুলো তাঁর বাধ্যতায় চলে। ঈশ্বরের বিধানের প্রতি বাধ্যতার কারণেই শস্যের বীজ ফেটে গিয়ে তার শিকড় মাটির গভীরে ছড়িয়ে পড়ে, “প্রথমে অঙ্কুর, পরে শীষ, তাহার পর শীষের মধ্যে পূর্ণ শস্য,” মার্ক ৪:২৮। এগুলোকে ঈশ্বর নিরূপিত সময়ে বৃদ্ধি দান করবেন, কারণ এগুলো তাঁর কাজে বিরোধিতা সৃষ্টি করেনি। তাহলে যে মানুষকে ঈশ্বর তাঁর নিজ প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন, তাকে এত বুদ্ধি বিবেচনা ও কথা বলার সামর্থ্য দিয়েছেন, সে কি করে তাঁর এই সকল দানের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে এবং তাঁর ইচ্ছার অবাধ্য হয়? সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও আমরাই আমাদের পৃথিবীতে কি অযৌক্তিক কাজটি করছি? COLBen 65.2
মানুষের টিকে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তাতে ঈশ্বরীয় ও মানবীয় উভয় দিক থেকে নিজ নিজ ভূমিকা দেখা যায়। বীজ বপনের ক্ষেত্রে যতক্ষণ না মানুষ তার হাত ব্যবহার করে নিজ দায়িত্ব সম্পাদন করছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনভাবেই ফসল সংগ্রহের কথা চিন্তা করা যায় না। কিন্তু সূর্যের আলো ও বৃষ্টি, শিশির ও মেঘের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর ফসলের পরিচর্যার যে মাধ্যম তৈরি করে রেখেছেন, সেগুলো ব্যতীত কখনোই ফসল বৃদ্ধি পেতে পারে না। প্রতিটি ব্যবসায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায়। এভাবেই তা জড়িয়ে রয়েছে আত্মিক পরিসীমায়, চরিত্রের গঠনে ও প্রত্যেকটি খ্রীষ্টিয় কার্যক্রম। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে এবং আমাদের এই দায়িত্বগুলোর সমন্বয় সাধন করতে হলে আমাদের ঈশ্বরীয় শক্তি অর্জন করতে হবে, নতুবা আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। COLBen 66.1
মানুষ যখন আধ্যাত্মিক বা জাগতিকভাবে কোন কিছু সম্পাদন করে, তখন তার অন্তরে এই চিন্তা ধারণ করা প্রয়োজন যে, সে তার সৃষ্টিকর্তার সহায়তায় সেটি করতে সক্ষম হয়েছে। ঈশ্বরের প্রতি আমাদের নির্ভরতা অনুধাবন করার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ এখন তার নিজের উপরে অনেক বেশি আস্থা রাখে, তার নিজ উদ্ভাবনের উপরে অনেক বেশি নির্ভর করে। ঈশ্বরের শক্তি ও কর্তৃত্বের উপরে খুব কমই এখন আমরা নির্ভর করি। “আমরা ঈশ্বরেরই সহকার্যকারী,” ১ করি ৩:৯। আমাদের মানবীয় সত্তার অংশটি চরমভাবে দুর্বল; কিন্তু যদি তা খ্রীষ্টের স্বর্গীয় সত্বার সাথে সংযুক্ত হয়, তাহলে সে খ্রীষ্টের শক্তি ও কর্তৃত্বের বলে আমরা সব কিছু করতে পারে। বীজ থেকে উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগম ও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি লাভ করা শিশু প্রশিক্ষণের একটি বিষয়ভিত্তিক পাঠ। এখানে “প্রমে অঙ্কুর, পরে শীষ, তাহার পর শীষের মধ্যে পূর্ণ শস্য।” যিনি এই দৃষ্টান্তটি দিয়েছেন তিনিই এই ক্ষুদ্র বীজের জন্ম দিয়েছেন, সেটিকে প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদানে পূর্ণ করেছেন এবং প্রকৃতির নিয়মে তাকে বৃদ্ধি লাভের সক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি এই দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা দিয়েছেন তা তাঁর নিজ জীবনে বাস্তব হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তাঁর শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উভয় স্বভাবে এই তৃণের মত বৃদ্ধি লাভের জন্য ঈশ্বরীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। আর তিনি চান যেন সমস্ত যুবকদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটে। যদিও তিনি ছিলেন স্বর্গের মহারাজ, গৌরবের রাজা, তথাপি তিনি বৈথলেহমে এক ক্ষুদ্র শিশু হয়ে জন্ম নিলেন, এবং পুরো শৈশবটি তিনি শুধুমাত্র তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানে একটি সাধারণ মানব শিশুর মতই বেড়ে উঠেছেন। শৈশবে তিনি একজন বাধ্য শিশুর মত কাজ করেছেন। তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত নয়, বরং একজন শিশুর মত জ্ঞান নিয়ে কথা বলেছেন ও কাজ করেছেন। তিনি তাঁর পিতা মাতাকে সম্মান বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের বাধ্য থেকে তাদের ইচ্ছানুসারে একজন শিশুর সাধ্যানুসারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে তিনি ছিলেন নিখুঁত, তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু পাপবিহীন ও অনুগ্রহে পূর্ণ। পবিত্র শাস্ত্রে তাঁর শৈশব সম্পর্কে বলা হয়েছে, “পরে বালকটি বাড়িয়া উঠিতে ও বলবান হইতে লাগিলেন, জ্ঞানে পূর্ণ হইতে থাকিলেন; আর ঈশ্বরের অনুগ্রহ তাঁহার উপরে ছিল।” অপরদিকে তাঁর তারুণ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “পরে যীশু জ্ঞানে ও বয়সে এবং ঈশ্বরের ও মনুষ্যের নিকটে অনুগ্রহে বৃদ্ধি পাইতে থাকিলেন,” লূক ২:১০, ৫২। COLBen 66.2
এখানে পিতা মাতা ও শিক্ষকদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হবে এমনভাবে যুবকদের মানসিকতা তৈরি করা যেন তারা তাদের জীবনের প্রত্যেকটি পর্যায়ে গিয়ে তাদের বয়সের সাথে মানানসই স্বভাবগত সৌন্দর্য প্রকাশ করতে সক্ষম হয়, ঠিক যেভাবে উদ্যানে তৃণ বিকশিত হয়। COLBen 67.1
সেই সমস্ত শিশুই সবচেয়ে আকর্ষণীয়, যারা স্বভাবগতভাবে স্বাভাবিক এবং অনাক্রান্ত সাদাসিধা। তাদেরকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া এবং তাদের সামনে তাদের পাকা পাকা কথাগুলো বারবার আওড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাদের চেহারা, তাদের কথা, বা তাদের কাজের প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে অসার পার্থিবতার প্রতি উৎসাহিত করা উচিত নয়। তাদেরকে কখনোই দামী বা লোক দেখানো জমকালো পোশাক পরানো উচিত নয়। এতে তাদের মধ্যে তৈরি হয় গর্ব এবং তাদের বন্ধুদের অন্তরে ঈর্ষার উদ্ভব ঘটে। COLBen 68.1
ছোট ছোট শিশুদেরকে শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। তাদেরকে ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দিয়ে সেগুলোতে অভ্যস্ত করে তুলা উচিত, কাজগুলো যেন তাদের বয়সের উপযোগী, আনন্দপূর্ণ এবং এই কাজের অভিজ্ঞতা যেন তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য সুফলজনক হয় সে ব্যাপারে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। দৃষ্টান্তের অঙ্কুর হচ্ছে শৈশব এবং এই অঙ্কুরের নিজস্ব একটি সৌন্দর্য রয়েছে। শিশুদেরকে জোর করে পরিপক্ক করে তোলার কোন প্রয়োজন নেই। বরং তাদেরকে যত দিন সম্ভব শৈশবের এই সজীবতা ও অনুগ্রহের মাঝে ধরে রাখা আবশ্যক। COLBen 68.2
শৈশবে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে ছোট শিশুরা হয়তো খ্রীষ্টান হয়ে উঠবে। এই গুণগুলোই ঈশ্বর তাদের মধ্যে দেখতে চান। তাদেরকে আত্মিকতার শিক্ষা দিতে হবে; শিশুরা যেন তাদের চরিত্রে খ্রীষ্টকে ফুটিয়ে তুলতে পারে সেজন্য পিতা মাতার সুযোগ দেয়া উচিত। COLBen 68.3
প্রকৃতিতে ঈশ্বরের বিধান, সব সময় নির্ভুলভাবে আবর্তিত হতে থাকে। ফসল কর্তনের কাজ প্রকাশ করে যে, বীজ বপনের কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করা হয়েছিল। অলস কার্যকারী তার কাজের মধ্য দিয়েই দোষী সাব্যস্ত হয়। তার ফসল তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। আত্মিকতার ক্ষেত্রেও তাই: প্রত্যেক কার্যকারীর বিশ্বস্ততা তার কাজের ফলাফল দিয়ে পরিমাপ করা হবে। তার কাজে সে বিশ্বস্ত নাকি অলস ছিল, সেটা তার ফসলের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাবে। এভাবেই অনন্তকালের জন্য তার গন্তব্য নির্ধারিত হবে। COLBen 68.4
প্রত্যেকটি বপনকৃত বীজ একই রকম ফসল দেবে। মানব জীবনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমাদের প্রত্যেককে সহানুভূতি, দয়া, ও ভালবাসার বীজ বপন করতে হবে; কারণ আমরা যা বুনব সেটাই কাটব। স্বার্থপরতা, আত্মপ্রেম, ও আত্ম-অহমিকা দ্বারা চালিত প্রত্যেকটি কাজ ঠিক একই ধরনের ফল বয়ে নিয়ে আসবে। যে ব্যক্তি তার নিজের জন্য বাঁচে সে মাংসে বীজ বপন করছে এবং সে ধ্বংসই কাটবে। COLBen 68.5
ঈশ্বর কোন মানুষকে বিনষ্ট করেন না। যে কোন মানুষ যদি বিনষ্ট হয় তাহলে সে আসলে নিজেই নিজেকে বিনষ্ট করেছে। যে সমস্ত লোকেরা তাদের বিবেককে দমিয়ে রাখে তারা অবিশ্বাসের বীজ বপন করছে এবং তা তৈরি করবে বিনাশের ফল। ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা প্রম সতর্কবাণী উপেক্ষা করার কারণে প্রাচীন মিসরের ফরৌণ কঠিন মনের বীজ বপন করেছিল এবং ফলে সে কঠিন সাজা পেয়েছিল। ঈশ্বর ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে দিয়ে অবিশ্বাস করাননি। অবিশ্বাসের বীজ বপন করলে তা একই ফল উৎপন্ন করে। এভাবেই ফরৌণের অন্তর ক্রমেই বিশ্বাস থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। এর পরিবর্তন ঘটে যখন সে তার বিধ্বস্ত দেশের দিকে এবং তার নিজের ও মিসরের সমস্ত পরিবারের মৃত প্রমজাত সন্তানের তাকানো ও তার সমস্ত সৈন্য বাহিনী, ঘোড়া ও রথ সমুদ্রে সলিল সমাধি ঘটেছিল। তার জীবন এই ভয়ঙ্কর সত্যটিকে প্রকাশ করে: “কেননা মনুষ্য যাহা কিছু বুনে তাহাই কাটিবে,” গালা ৬:৭। মানুষ যদি সত্যিকার অর্থে এ কথা অনুধাবন করতে পারত, তাহলে তারা যে বীজ বুনছে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকত। COLBen 69.1
বপন করা বীজ ফসল উৎপাদন করে এবং সেই ফসল আবারও বীজ হিসেবে বপন করা হয়, এতে ফসল আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই বিধান অবধারিতভাবে সত্য। আমাদের প্রত্যেকটি কথা ও প্রত্যেকটি কাজ একেকটি বীজ, যা অবশ্যই সে অনুসারে ফল ধারণ করবে। সুচিন্তিতভাবে করা দয়ার কাজ, বা বাধ্যতা, কিংবা আত্ম সংযমের কাজ অন্যদের মধ্যেও সেই একই কাজ করার উদ্দীপনা তৈরি করবে এবং এভাবে তাদের মধ্য দিয়ে অন্যরাও এই একই কাজ করার জন্য উদ্দীপ্ত হবে। সে কারণে ঈর্ষা, প্রতিহিংসা বা অসহিষ্ণুতার প্রত্যেকটি কাজ হচ্ছে সেই সমস্ত বীজ যা অঙ্কুরিত হলে বেরিয়ে আসে “তিক্ততার মূল” (ইব্রীয় ১২:১৫), যা অনেককে এক সাথে বিনষ্ট করে। এবং এই “অনেক” বিষাক্রান্ত লোক কত সংখ্যক হতে পারে এভাবেই সৃষ্টির শুরু থেকে অনাদিকাল পর্যন্ত ভাল ও মন্দ বীজ এক সাথে বপন করা হচ্ছে ও তা বেড়ে উঠছে। COLBen 69.2
বীজবাপকের দৃষ্টান্তে আত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। প্রভু বলেছেন, “ধন্য তোমরা, যাহারা সমস্ত জলপ্রবাহের ধারে বীজ বপন কর, যাহারা গরু ও গর্দভকে চরিতে দেও,” যিশাইয় ৩২:২০। “কিন্তু আমি বলি এই, যে অল্প পরিমাণে বীজ বুনে, সে অল্প পরিমাণে শস্যও কাটিবে; আর যে ব্যক্তি আশীর্বাদের সহিত বীজ বুনে, সে আশীর্বাদের সহিত শস্যও কাটিবে,” ২ করিন্থীয় ৯:৬। সমস্ত জলপ্রবাহের ধারে বীজ বপন করার অর্থ হচ্ছে অনবরত ঈশ্বরের অনুগ্রহ সহভাগ করতে থাকা। এর অর্থ হচ্ছে ঈশ্বরের আহ্বানের কারণে কিংবা মানুষের অভাব মোচনে আমাদের দান করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দান করার মধ্য দিয়ে কেউ দরিদ্র হয়ে পড়ে না। “যে ব্যক্তি আশীর্বাদের সহিত বীজ বুনে, সে আশীর্বাদের সহিত শস্যও কাটিবে।” বীজ বপনকারী তার বীজগুলো ছড়িয়ে দেয় বলেই সে তা আরও বহুগুণে ফিরে পায়। যারা ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া অনুগ্রহ দান বিশ্বস্ততার সাথে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়, তাদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম ঘটে। দান করার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বর তাদেরকে এমন এক স্বচ্ছলতার প্রতিজ্ঞা দেন যেন তারা সব সময় এই দান দিয়ে যেতে পারে। “দেও, তাহাতে তোমাদিগকেও দেওয়া যাইবে; লোকে প্রচুর পরিমাণে চাপিয়া ঝাঁকাইয়া উপচিয়া পড়িবার মত করিয়া তোমাদের কোলে দিবে; কারণ তোমরা যে পরিমাণে পরিমাণ কর, সেই পরিমাণে তোমাদের জন্যও পরিমাণ করা যাইবে,” লূক ৬:৩৮। COLBen 70.1
বীজ বপন ও ফসল কাটার দৃষ্টান্তে আরও গভীর নিগূঢ় তত্ত্ব রয়েছে। যখন আমরা ঈশ্বর প্রদত্ত জাগতিক আশীর্বাদের বিষয়গুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেব, তখন সেই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের ভালবাসা ও সহানুভূতির কারণে তাদের অন্তরে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার মনোভাব সৃষ্টি হবে। তাদের অন্তরের ভূমি আত্মিক সত্যের বীজ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হবে। যিনি বীজ বপনকারীর কাছে সমস্ত বীজ দিয়ে থাকেন তিনি সেই বীজগুলোকে অঙ্কুরিত করবেন এবং তা অনন্ত জীবনের ফল ধারণ করবে। COLBen 70.2
জমিতে বীজ ছিটানোর মধ্য দিয়ে খ্রীষ্ট তাঁর নিজেকে আমাদের জন্য উৎসর্গ করাকে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “গমের বীজ যদি মৃত্তিকায় পড়িয়া না মরে, তবে তাহার একটিমাত্র থাকে; কিন্তু যদি মরে, তবে অনেক ফল উৎপন্ন করে,” যোহন ১২:২৪। সে কারণে খ্রীষ্টের মৃত্যু নিজেদেরকেই ঈশ্বরের রাজ্যের জন্য ফলদান করবে। উদ্ভিদের জগত যে বিধান অনুসারে পরিচালিত হয়, সে অনুসারে খ্রীষ্টের মৃত্যু জীবনের সূচনা করেছে। COLBen 71.1
যারা খ্রীষ্টের সাথে একত্রে তাঁর সহকর্মী হয়ে ফল ধারণ করতে চাইবে, তাদের প্রমে ভূপাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সবাইকে প্রয়োজনের জন্য অবশ্যই ভূমিতে জীবন দান করতে হবে। আত্মপ্রেম ও স্বার্থপরতা বর্জন করতে হবে। কিন্তু আত্মোৎসর্গের অর্থ হচ্ছে নিজেকে অনন্ত জীবনের জন্য সুরক্ষিত রাখা। ভূমিতে বপনকৃত বীজ ফল উৎপাদন করে এবং এই ফল উৎপাদনের জন্যই বীজ বপন করা হয়েছে। এভাবেই ফসল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। কৃষক তার বীজ ভূমিতে ছড়িয়ে দিয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি করে। মানব জীবনও ঠিক তাই। দান করার মাঝেই নিহিত রয়েছে জীবন। যে জীবন ঈশ্বর ও মানুষের সেবার নিঃস্বার্থে বিলিয়ে দেয়া হয়, সেই জীবন রক্ষা পাবে। যারা খ্রীষ্টের জন্য এই জগতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে তাদের জন্য অনন্ত জীবন প্রস্তুত করা হয়েছে। COLBen 71.2
নতুন একটি জীবনের সূচনা ঘটানোর জন্যই বীজ মৃত্যুবরণ করে; এর মধ্য দিয়ে আমরা পুনরুত্থানের শিক্ষা পাই। যারা যারা ঈশ্বরকে ভালবাসে তারা সবাই আবারও স্বর্গের এদন উদ্যানে বসতি করবে। যে মানব দেহ মৃত্যুর পর কবরে পচে বিনষ্ট হয় তার সম্পর্কে ঈশ্বর বলেছেন, “ক্ষয়ে বপন করা যায়, অক্ষয়তায় উত্থাপন করা হয়; অনাদরে বপন করা যায়, গৌরবে উত্থাপন করা হয়; দুর্বলতায় বপন করা যায়, শক্তিতে উত্থাপন করা হয়,” ১ করিন্থীয় ১৫:৪২, ৪৩। COLBen 71.3
জীবন্ত প্রকৃতি থেকে নেয়া বীজ বপনকারী ও বীজের দৃষ্টান্ত থেকে পাওয়া যায় এমন অনেক শিক্ষার মধ্য হতে এখানে কয়েকটি শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। বাবা মা ও শিক্ষকেরা যখন এই শিক্ষাগুলো দেয়ার চেষ্টা করবেন, তখন তাদেরকে হাতে কলমে কাজ করতে হবে। শিশুদের ভূমি প্রস্তুত করার ও বীজ বপন করতে দিতে হবে। যখন তারা কাজগুলো করবে, তখন বাবা মা বা শিক্ষকেরা উদ্যানরূপ অন্তর, এবং সেখানে বপনকৃত ভাল ও খারাপ বীজের ব্যাখ্যা দিতে পারেন; এবং যেমন বাগানগুলো প্রাকৃতিক বীজগুলোর জন্য প্রস্তুত করা হয়, তদ্রুপ তাদের হৃদয়গুলো সত্যের বীজগুলোর জন্য প্রস্তুত করতে হবে। যেমন ভূমিতে বীজ ফেলা হয়, তদ্রুপ তারা শিশুদেরকে খ্রীষ্টের মৃত্যু সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারেন; এবং যখন সেই বীজ অঙ্কুরিত হবে, তখন তারা শিশুদেরকে পুনরুত্থানের শিক্ষা দিতে পারেন। বীজ অঙ্কুরিত হয়ে যখন সেই তৃণ বৃদ্ধি লাভ করতে থাকবে, তখনও প্রাকৃতিক ও আত্মিক বীজ বপনের এই সুসমন্বিত শিক্ষা চলমান থাকবে। COLBen 71.4
যুবকদেরকেও একইভাবে শিক্ষা দেয়া উচিত। তাদেরকে জমি চাষ করা শেখাতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের সাথে লাগোয়া আবাদি জমি থাকে। এ ধরনের জমিকে স্বয়ং ঈশ্বরের শিক্ষাদানের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। প্রকৃতির সমস্ত উপাদানকে ঈশ্বরের পাঠ্য পুস্তক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে যা তাঁর সন্তানেরা অধ্যয়ন করবে এবং যেখান থেকে তারা ঐশ্বরিক ও জাগতিক জ্ঞান লাভ করবে। COLBen 72.1
জমি চাষ করা, মাটি সমান করা, ও আগাছা পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে একটি চলমান শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চলবে। কেউই ভূমি চাষ করার পর তাতে বীজ না বুনে ফেলে রাখবে না। বীজ বপনের জন্য ভূমি প্রস্তুত করতে হলে তাতে প্রয়োজন একাগ্রতা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম। মানব হৃদয়ে আত্মার কাজও ঠিক একই রকম হয়ে থাকে। যারা জমি চাষ করার মধ্য দিয়ে সুফল লাভ করবে, তাদের অবশ্যই নিজ অন্তরে ঈশ্বরের বাক্য ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। তখন তারা পবিত্র আত্মার নম্রকারী ও পরিবর্তন সাধনকারী প্রভাবের কারণে তাদের ভগ্ন ও চূর্ণ হৃদয়ের অনাবাদী জমি খুঁজে পাবে। যে পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করা না হবে, সে পর্যন্ত সেই ভূমিতে ফসল কাটতে পারবে না। অন্তরের ভূমিও ঠিক তেমন। ঈশ্বরের গৌরবের জন্য অন্তরের ফল প্রস্ফূটিত হওয়ার আগে তা পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জিত করে তোলার জন্য অবশ্যই ঈশ্বরের আত্মার কার্য সাধন করতে হবে। COLBen 72.2
যদি মানবীয় সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা অন্তর চালিত হয় তাহলে ভূমি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ফসল উৎপাদন করবে না। প্রতিদিন ঈশ্বরীয় আত্মার দ্বারা এই অন্তরকে পরিচালনা দান করতে হবে। গভীরভাবে ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে অন্তরের এই ভূমি চাষ করতে হবে। অন্তরে রোপিত বীজ থেকে যে সমস্ত আগাছা সমস্ত পুষ্টি কেড়ে নেয়, সে সমস্ত আগাছা সমূলে উৎপাটন করতে হবে। ফলবিহীন আশায় পরিপূর্ণ অন্তরকে ফলে পূর্ণ করে তুলতে হলে চাই আন্তরিক ও একাগ্র পরিচর্যা। COLBen 72.3
প্রকৃতি থেকে আত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করে যারা এই প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তরকে প্রস্তুত করে তুলবে, তাদের অন্তরেই প্রভুর আশীর্বাদ বর্ষিত হবে। ভূমি চাষ করার সময় কার্যকারী জানে না যে কী সম্পদ তার জন্য সামনে অপেক্ষা করছে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনা অবজ্ঞা করা তার জন্য অনুচিত হবে। বস্তুত মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে একজন বুদ্ধিমান মানুষ তার নিজের জীবনের জন্য শিক্ষা লাভ করে। এটি তার প্রশিক্ষণের একটি অংশ। জমি চাষ করা আত্মার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা হিসেবে পরিগণিত হবে। COLBen 73.1
যিনি বীজ হতে অঙ্কুরোদগম ঘটান, যিনি দিনে ও রাতে তার যত্ন নেন, যিনি তাকে বেড়ে ওঠার শক্তি দেন, তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা, স্বর্গের রাজা, এবং তিনি প্রতিনিয়ত তাঁর সন্তানদের যত্ন নেন ও তাদের জন্য চিন্তা করেন। জাগতিক বীজবাপক যেমন আমাদের জাগতিক জীবন রক্ষার জন্য বীজ বপন করেন, তেমনি স্বর্গীয় বীজবাপক আমাদের অন্তরে এমন বীজ বপন করেন অনন্ত জীবনের ফল ধারণ করবে। COLBen 73.2